এই লেখার প্রথম পর্বে (‘মেয়েরাই তো মেনে নেন’, ১২-১২) দেখানো হয়েছে, এ দেশের মেয়েদের একটা বড় অংশই মনে করেন, তাঁদের উপর পরিবারের মধ্যে যে হিংসা চলে, সেটা যুক্তিযুক্ত। প্রশ্ন হল, তাঁরা ঠিক কারা? তাঁরা কোথায় থাকেন? তাঁদের শিক্ষার হাল কেমন? কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান দেখা যাক। তাঁদের মধ্যে ৭৩% গ্রামে থাকেন এবং বাকি ২৭% থাকেন শহরে বা শহরতলিতে। শিক্ষার প্রশ্নে যে পরিসংখ্যানগুলি উল্লেখের দাবি রাখে সেগুলি হল: যে নারীরা গার্হস্থ্য হিংসার সমর্থনকারী, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩১% অশিক্ষিত। শুধু তা-ই নয়, যে নারীরা গার্হস্থ্য হিংসার সমর্থক, তাঁদের মধ্যে ৫৬% দশম শ্রেণি অবধি বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষালাভ করেছেন। অর্থাৎ গার্হস্থ্য হিংসা যে নারীরা যুক্তিযুক্ত মনে করেন, তাঁদের মধ্যে প্রতি দ্বিতীয় জন অন্তত দশম শ্রেণির গণ্ডি পেরিয়েছেন। অতএব ভারতীয় নারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে তাঁদের গার্হস্থ্য হিংসার প্রতি মনোভাবের বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে লক্ষ করা যাচ্ছে না।
সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে যাঁরা গার্হস্থ্য হিংসা যুক্তিযুক্ত মনে করেন, এ বার আসা যাক তাঁদের জাতি এবং অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণে। এঁদের মধ্যে ২০% নারী তফসিলি জাতির অন্তর্ভুক্ত, ২০% অন্তর্ভুক্ত তফসিলি জনজাতির, ৪২% অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি), এবং ১৮% উচ্চবর্ণের। যে নারীরা গার্হস্থ্য হিংসাকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন তাঁরা কি অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের সদস্য? অর্থাৎ, গার্হস্থ্য হিংসাকে যুক্তিযুক্ত মনে করাটা কি আসলে দারিদ্র-জনিত সমস্যা? পরিসংখ্যান সে কথা বলছে না। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সমস্ত নারীর পরিবারকে ধনসম্পত্তির নিরিখে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হলে দেখা যাচ্ছে, যে ৫৯,৫৯০ জন নারী মনে করেন এক বা একাধিক গার্হস্থ্য হিংসা যুক্তিযুক্ত, তাঁদের মধ্যে ১১,৭৭৯ জনের পরিবারের অবস্থান ধনসম্পত্তির বণ্টনে সবচেয়ে নীচের ভাগে। অর্থাৎ, যে নারীরা গার্হস্থ্য হিংসার সমর্থক, তাঁদের মাত্র ২০% অত্যন্ত গরিব। বাকি ৮০% অর্থনৈতিক ভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের মধ্যে পড়েন না।
অতএব যা দাঁড়াচ্ছে তা হল এই: এক, গার্হস্থ্য হিংসার প্রতি ভারতীয় নারীদের মনোভাব যা হওয়া উচিত তার থেকে তা শত যোজন দূরে। দুই, গার্হস্থ্য হিংসার প্রতি মনোভাবের সমস্যা মূলত গ্রামে বসবাসকারী নারীদের হলেও, এমন কথা বলা চলে না যে, শহরের নারীরা সবাই মনে করেন গার্হস্থ্য হিংসা কোনও কারণেই যুক্তিযুক্ত নয়। বস্তুত, যদি দশ জন নারী মনে করেন গার্হস্থ্য হিংসা যুক্তিযুক্ত, তাঁদের মধ্যে গড়পড়তা তিন জন শহর বা শহরতলিতে থাকেন। তিন, শিক্ষার সঙ্গে গার্হস্থ্য হিংসার প্রতি নারীদের মনোভাবের বিশেষ সম্পর্ক নেই। যে নারী গার্হস্থ্য হিংসা যুক্তিযুক্ত বলে বিশ্বাস করেন, তাঁর অশিক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা যতটা, তার থেকে অনেক বেশি সম্ভাবনা তাঁর অপেক্ষাকৃত ভাবে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার। চার, কোনও মতেই বলা যাবে না যে গার্হস্থ্য হিংসা কেবল তফসিলি জাতি-জনজাতি বা অন্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত নারীদের সমস্যা। যে নারীরা মনে করেন গার্হস্থ্য হিংসা যুক্তিযুক্ত, বিভিন্ন জাতির মধ্যে তাঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। পাঁচ, ধনসম্পত্তির নিরিখেও গার্হস্থ্য হিংসার প্রতি নারীদের মনোভাবের সমস্যা প্রায় সর্বব্যাপী— কেবল দরিদ্র পরিবারেই নয়।
সন্দেহ নেই, গার্হস্থ্য হিংসা রোধ করার অন্যতম হাতিয়ার গার্হস্থ্য হিংসার প্রতি নারীদের মনোভাব বদলানো। কিন্তু কাজটি অত্যন্ত কঠিন। কেবল স্কুলশিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে বা মেয়েদের স্কুলছুট হওয়া বন্ধ করে এই কঠিন কাজটি সম্পন্ন করা যাবে বলে মনে হয় না। সমস্যাটি কেবল নিম্নবর্ণ বা নিম্ন অর্থনৈতিক শ্রেণির মধ্যে আবদ্ধ নয়। তাই, যে সমস্ত সরকারি প্রকল্প সমাজের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত, সেই প্রকল্পগুলি যদিও বা এই মানুষগুলিকে কিছুটা আর্থ-সামাজিক সুযোগসুবিধে পাইয়ে দিতে সক্ষম হয়, সেগুলি ভারতীয় নারীদের গার্হস্থ্য হিংসা সংক্রান্ত মনোভাব কতটা বদলাতে পারবে তা বলা কঠিন। সুতরাং আমাদের দেশে যে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পগুলি প্রধানত নিম্নবিত্ত নারীদের বাল্যবিবাহ বন্ধ করে তাঁদের স্কুল শিক্ষা সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত, সেগুলির দ্বারা গার্হস্থ্য হিংসার প্রতি তাঁদের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটাতে পারার সম্ভাবনা বেশ কম। হয়তো সেই কারণেই ‘কন্যাশ্রী’, ‘আপনি বেটি আপনা ধন’ বা ‘সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা’-র মতো প্রকল্প থাকলেও, এবং সেগুলি বাল্যবিবাহ রোধ করতে বা স্কুলছুটের হার কমাতে পারলেও, দেশে গার্হস্থ্য হিংসার সঙ্কট এখনও অত্যন্ত গভীর।
সম্ভবত আমাদের দেশের নারীদের গার্হস্থ্য হিংসার প্রতি মনোভাব বদলানোর জন্য সরকারি এবং বেসরকারি স্তরে আধুনিক এবং কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত, যা কেবল একটি শ্রেণির নারীদের (যেমন দরিদ্র বা অশিক্ষিত বা তফসিলি জাতি-জনজাতির) জন্য নির্দিষ্ট হবে না। এমন একটি পদ্ধতি হতে পারে বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান (edutainment), যা করা যেতে পারে সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি, রেডিয়ো, খবরের কাগজ, এমনকী পথনাটিকার মাধ্যমে। বেশ কিছু দেশে (যেমন অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব ও নিকারাগুয়া) গার্হস্থ্য হিংসার প্রতি নারীদের মনোভাব বদলানোর জন্য এমন বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের মতো গণমাধ্যম-ভিত্তিক প্রচার ইতিমধ্যেই পুরো দমে শুরু হয়ে গিয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সেই সব দেশে এই প্রচার-প্রকল্পগুলি গার্হস্থ্য হিংসা সংক্রান্ত নারীদের মনোভাব বদলাতে পেরেছে। আমাদের দেশেও এ রকম গণমাধ্যম-ভিত্তিক প্রচারের দু’একটি পদক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি দুই স্তরেই, এই ধরনের উদ্যোগের ব্যাপক সম্প্রসারণ দরকার।
কৃতজ্ঞতা: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট ইনদওর-এ অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy