সাংবাদিক জামাল খাশোগি।—ছবি এপি
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি জানিতেন যে তিনি তাঁহার দেশের ক্ষমতাধারীদের নিকট একান্ত অপ্রিয়। তিনি জানিতেন যে কোনও ভাবে তাঁহার বিদ্রোহী সত্তা ও মতামতের মূল্য তাঁহাকে তাঁহার দেশে চুকাইতে হইতেই পারে। সঙ্গে অবশ্য তিনি ইহাও ভাবিয়াছিলেন যে তুরস্ক সৌদি আরবের বিশেষ মিত্র দেশ না হওয়ার কারণে তুরস্কে থাকিতে তাঁহার ভয় পাইবার কারণ নাই। এতৎসত্ত্বেও যখন ইস্তানবুলের সৌদি দূতাবাসে তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠানো হয়, তিনি স্বস্তিবোধ করিতেছিলেন না। তাঁহার বান্ধবী পরে বলিয়াছেন, খাশোগি বেশ খানিকটা ভয়েই ছিলেন। তবু নিজেকেই নিজে প্রবোধ দিয়াছিলেন, বিদেশের মাটিতে তাঁহার দেশের দূতাবাস নিশ্চয় তাঁহার কোনও ক্ষতি করিবে না। তিনি ভুল ভাবিয়াছিলেন। কর্তৃত্ববাদের কদর্য হাত যে কত দূর প্রসারিত হইতে পারে, তাহার মূল্যায়নটি খাশোগির মতো বিচক্ষণ সাংবাদিকও করিয়া উঠিতে পারেন নাই। তাই ইস্তানবুলের সৌদি দূতাবাসে প্রবেশ করিবার পর তিনি আর জীবিত বাহির হইতে পারেন নাই। তাঁহার দেশ প্রথমে মানিতেও চাহে নাই যে এই বিষয়ে তাহাদের হাত আছে। শেষ পর্যন্ত তিন সপ্তাহেরও বেশি পরে সৌদি আরবের পক্ষ হইতে স্বীকার করা হইয়াছে যে খাশোগি নিহত হইয়াছেন, এবং পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক সেই নিধন। এই ঘটনায় সৌদি রাজপরিবারের হাত আছে কি নাই, তাহা এখনও বিতর্কিত, এবং এক দিক দিয়া, অপ্রাসঙ্গিক। দূতাবাসের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটিলে তাহার দায় দেশকেই লইতে হইবে, যাহার হাতই থাকুক। স্বাভাবিক ভাবেই খাশোগি হত্যা অনেক দিক দিয়া আলোড়ন তুলিবার মতো। একে তো পশ্চিম এশিয়ার সদা-উত্তপ্ত পরিবেশের নিরিখেও এমন সংবাদ সচরাচর মিলে না। সৌদি ক্ষমতার ঔদ্ধত্য কোন সীমা পার হইয়াছে, এবং ভিন্ন গোলার্ধের কোন শক্তির নিহিত সমর্থনে সেই ঔদ্ধত্য এমন মাত্রাছাড়া হইয়াছে, খাশোগির দুর্ভাগ্যজনক পরিণতিতে তাহারই ইঙ্গিত।
এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় ভাবিবার প্রয়োজন। কূটনৈতিক ছাড় বলিয়া যে রীতিটি রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশে চালু রহিয়াছে, তাহার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে যদি কোনও কুকীর্তি, এমনকি সরাসরি ঘৃণ্য অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে কর্তব্য কী? খাশোগির নিধনকারীরা কি এই ‘ছাড়’-এর কল্যাণে বিচারের আওতার বাহিরে থাকিয়া যাইবেন? রিয়াধ এখনও অবধি সত্য গোপনের নানা চেষ্টা করিতেছে। এই ধারাবাহিক প্রয়াস ইঙ্গিত করে যে এই বিষয়ে সৎ ও স্পষ্ট তদন্ত সেই দেশ না-ও করিতে পারে। তাহা হইলে এই তদন্ত কে করিবে, কাহার এক্তিয়ারে পড়িবে, ঘটনার দায় কে লইবে? এগুলি সবই বেশ গভীর ও জটিল প্রশ্ন: সহজে মীমাংসা না মিলিলেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিষয়গুলি এখনই বিবেচনা দাবি করে। তৎসঙ্গে ইহাও সত্য যে, সৌদির সহিত পার্শ্ববর্তী অ-বন্ধুসুলভ দেশগুলির সম্পর্কেও এই ঘটনার ফলে বড় গোছের অবিশ্বাস জমা হইল— দীর্ঘ মেয়াদে দেখিলে যাহার ফলে আঞ্চলিক অস্থিরতার সঙ্কট ও ইসলামি কট্টরবাদের প্রকোপ বাড়িবার সম্ভাবনা। ওই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব আগামী অস্থিরতার অন্যতম প্রধান উপাদান হইবারও সম্ভাবনা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতিমধ্যেই খাশোগি-হত্যা লইয়া অসামান্য সব মন্তব্য করিয়া আরও এক বার কূটনীতি জগৎকে বিষম দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে গ্রস্ত করিয়াছেন। অন্য দিকে, নিহত খাশোগির সহিত ভারতের কিছু সুদূর সম্পর্কের কথা শোনা গিয়াছে। তবে কৌটিল্য-শাস্ত্র মতে, সেই সম্পর্কের সূত্র কোনও ভাবেই ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানের উপর দাগ ফেলিতে পারে না। ভারতের পক্ষে এই প্রসঙ্গে কেবল একটিমাত্র কাজ করিবার আছে। নানা সুযোগে তাহার মিত্রসুলভ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া যে, মানবাধিকার নামক বিষয়টি আর একটু গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করিলে সে দেশের, এবং সামগ্রিক পৃথিবীর, মঙ্গল ঘটিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy