একাকিত্ব শব্দটি প্রায় প্রত্যেকের মনেই নেতিবাচক দ্যোতনা বহিয়া আনে। কিন্তু তাহাকে অতিক্রম করিয়া, এককত্ব, বা স্বেচ্ছা-অসংস্রব যে অনেকের নিকট কাম্য হইতে পারে, সামাজিক জীব মানুষ সহজে তাহা বিশ্বাস করিতে পারে না। অথচ জাপানে ইহার বিপরীত মানসিকতা প্রবাহিত হইতে শুরু করিয়াছে। সেই দেশে এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে সদস্যের সংখ্যা মাত্র এক। এই একা থাকিবার বাধ্যতা বা অভ্যাসকে নিরুৎসাহ না করিয়া, কেবল একক উপভোগের জন্য নানা প্রকার বিনোদন প্রচলিত হইতেছে, একক প্রয়োজনের প্রতিও স্বতন্ত্র বাণিজ্য-নজর নিবদ্ধ হইতেছে। তৈরি হইয়াছে বহু ‘কারায়োকে পার্লার’, অর্থাৎ একা গান গাহিবার ক্ষুদ্র বুথ— যে কেহ বাজনা চালাইয়া তাহার সহিত নিজমনে গান গাহিয়া চলিতে পারেন। ইহা ক্রমশ জনপ্রিয় হইতেছে, গান গাহিবার ক্রিয়াটি একক ক্রিয়া হিসাবে প্রবল জনপ্রিয়তা পাইতেছে। বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে এমন আসন তৈরি হইতেছে যাহা অন্য সকল আসন হইতে বিচ্ছিন্ন। সমষ্টিগত অবকাশযাপনের উপকরণগুলিও ক্রমে একক উপভোগের ক্ষেত্র হিসাবে স্বীকৃতি পাইতেছে।
বহু সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, জাপানে কমবয়স্করা, পরিবারের সদস্যদের সহিত বা আত্মীয়বন্ধুদের সহিত সময় কাটাইবার তুলনায়, একা সময় কাটাইবার অভ্যাসকে অধিক মূল্য দিতেছে। অর্থাৎ বাধ্যতা নহে, প্রবণতাই এই নিরালাপ্রিয়তার মূল কারণ। অবশ্য কেবল জাপান কেন, সমগ্র বিশ্বের বিনোদনভোগের ধারার পরিবর্তন সাধারণ চক্ষে অনুধাবন করিলেই ইহার আন্দাজ পাওয়া যাইবে। মুক্ত আকাশের নীচে অগ্নিকুণ্ড ঘিরিয়া সমবেত সন্ধ্যা যাপন না-হয় সুদূর অতীত, কিন্তু কিছু কাল আগেও সন্ধ্যায় মানুষ অন্তত অনেকে মিলিয়া টিভি দেখিত। সেই যৌথতাও এখন স্বপ্নবৎ। কমবয়স্করা নিজ মোবাইলে বুঁদ হইয়া থাকিতেছে। মানুষ নিজ পছন্দানুযায়ী গান শুনিতেছে ছবি দেখিতেছে রসিকতা পড়িতেছে, যানবাহনে উঠিয়াও নিজ ব্যক্তিগত যন্ত্রটিতে মশগুল থাকিতেছে, পাশের লোকটি মরিল কি না দৃক্পাতও করিতেছে না। তর্ক করা যাইতে পারে, ওই যন্ত্রটি তাহাকে বহু মানুষের সহিত সংযুক্তও রাখিতে সক্ষম, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষ ভার্চুয়াল বিশ্বে একাই খুঁজিয়া লইতেছে সকল একঘেয়েমির প্রতিষেধক।
কেহ বলিতে পারেন, ইহা অমঙ্গলজনক, কারণ মানুষ কেবল মানুষের সঙ্গ হইতেই যথার্থ উষ্ণতা সংগ্রহ করিতে পারে। জাপানে বিভিন্ন মুদির দোকানে যে কেবল একার প্রয়োজন হিসাব করিয়া অন্নব্যঞ্জন বিক্রয় হইতেছে, অথবা ভ্রমণ সংস্থাগুলি একা ভ্রমণার্থীর ‘প্যাকেজ’ নির্মাণ করিতেছে— তাহা বাণিজ্য বাড়াইবে, কিন্তু বহু সামাজিক প্রতিবন্ধীর জন্ম দিতে পারে। অন্য কেহ পূর্বের মানুষটিকে রক্ষণশীল অভিহিত করিয়া বলিতে পারেন, দায়ে পড়িয়া মানুষ সামাজিক হইয়াছিল, আজ প্রযুক্তির বিপ্লব আসিয়া তাহাকে প্রকৃত স্বাধীন স্ববশ করিয়াছে। সে আজ সঙ্গবিমুখ, কারণ সে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মানুষের মানুষকে প্রয়োজন ছিল তত ক্ষণ, যত ক্ষণ সময় কাটাইবার সকল উপায় তাহার তালুবদ্ধ হয় নাই। আজ তাই সেই সকল ভান ছাড়িয়া বাহির হইয়া নিজ একচর্যা সদর্পে উদ্যাপন করিতেছে। আজ তাহার একা গলা ছাড়িয়া গান গাহিবার দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy