Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

স্কুলে দুধ দেবেন, না ফল?

বস্তুত, অনেক সময় তাঁদের বিদ্যাই তাঁদের পক্ষে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ হিসেবে স্কুলের খাবারে ডিম দেওয়ার প্রসঙ্গে ফেরা যেতে পারে। একটা পদ্ধতিগত প্রশ্ন হল, ডিমের জোগান কে দেবে— ঠিকাদার পাইকারি ভাবে ডিম সরবরাহ করবেন, না যিনি রান্না করেন তিনিই স্থানীয় বাজার থেকে তা কিনবেন। স্থানীয় বাজারে কেনার অনেক যুক্তি আছে, কিন্তু ঠিকাদার অনেক সময়েই জোরদার লবি করে।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

জঁ দ্রেজ়
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

এস্থার দুফলো মনে করেন, অর্থনীতিবিদরা প্লাম্বার হিসেবে ভাল (কে কাকে কী পরামর্শ দেয়, আনন্দবাজার, ৭-১১)। আমি তা মনে করি না। তাঁর মতে, নিজের শাস্ত্রে অর্থনীতিবিদদের প্রশিক্ষণের কারণেই তাঁরা যথেষ্ট দক্ষ; নীতি ও প্রকল্পের অনেকখানি চালনা করার মতো যোগ্যতা রাখেন। এ ব্যাপারে আমার ততটা ভরসা নেই। অর্থনীতিবিদদের নিশ্চয়ই অনেক কিছু দেওয়ার আছে, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য তাঁদের বিশেষ কোনও দক্ষতা থাকে না। ভারতের জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (এনরেগা) সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনার সময় এটা আমার প্রায়শই মনে হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা হল, এই প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় স্তরের প্রশাসক, গ্রাম স্তরের আধিকারিক, এমনকি এনরেগার কর্মীদের সঙ্গেও অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা চলতে পারে। একটা বড় ব্যাপার হল, তাঁরা প্রকল্প রূপায়ণে সরাসরি জড়িত, এই ব্যাপারে রীতিমতো ওয়াকিবহাল। অন্য দিকে, এ বিষয়ে বিদ্বজ্জনদের আলোচনাসভায় দেখেছি, অনেকেই প্রকল্পের বাস্তব ব্যাপারগুলো সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন না। অর্থনীতিবিদরা সেই ব্যাপারগুলো নিশ্চয়ই জেনে ও বুঝে নিতে পারেন, কিন্তু সে সব বিষয়ে তাঁদের আলাদা কোনও পারঙ্গমতা নেই।

বস্তুত, অনেক সময় তাঁদের বিদ্যাই তাঁদের পক্ষে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ হিসেবে স্কুলের খাবারে ডিম দেওয়ার প্রসঙ্গে ফেরা যেতে পারে। একটা পদ্ধতিগত প্রশ্ন হল, ডিমের জোগান কে দেবে— ঠিকাদার পাইকারি ভাবে ডিম সরবরাহ করবেন, না যিনি রান্না করেন তিনিই স্থানীয় বাজার থেকে তা কিনবেন। স্থানীয় বাজারে কেনার অনেক যুক্তি আছে, কিন্তু ঠিকাদার অনেক সময়েই জোরদার লবি করে। অ্যাডাম স্মিথ বলেছিলেন, ব্যবসায়ীরা যখন কোনও নীতির পক্ষে সওয়াল করেন তখন সেটা ‘কেবল খুব খুঁটিয়ে দেখলেই চলে না, অত্যন্ত সন্দিহান এবং সতর্ক দৃষ্টিতে’ তা যাচাই করা দরকার। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা সচরাচর কর্পোরেট স্বার্থের সমাজবিরোধী চরিত্র বিচার করতে পারদর্শী নন। ডিম বা অন্য সামগ্রী কী ভাবে সংগ্রহ করা উচিত, সে বিষয়ে তাঁদের অন্য নানা জ্ঞান থাকলেও, তাঁদের পরামর্শ খুব ভাল করে যাচাই করা দরকার।

চতুর্থত, নীতি বিষয়ক পরামর্শের নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত পরিণাম থাকতে পারে। নীতি রচনার সময় যে ফল চাওয়া হয়েছিল আর যা পাওয়া গিয়েছে, প্রায়শই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব থাকে। অর্থনীতিবিদরা জানেন, বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরস্পরের আচরণ সম্পর্কে কী অনুমান করবেন, নিজেরা কেমন আচরণ করবেন, সে সবের ওপর পরিণাম নির্ভর করে। সুতরাং নীতি রচনার সময় সেই জটিল ব্যাপারগুলো মাথায় রাখা দরকার। যেমন, ভারতের কিছু রাজ্যে নিরামিষাশীদের লবি খুব জোরদার, সেখানে সরকার স্কুলের খাবারে ডিমের বদলে দুধ দিতে চায়। কিন্তু দুধ চট করে নষ্ট হয়ে যায়, ফলে তা নিরাপদ নয়। এই সব রাজ্যে কৌশল হিসেবে হয়তো ডিমের বদলে ফলের দাবি জানানো বুদ্ধিমানের কাজ হত। আবার উল্টো যুক্তিও দেওয়া যায় যে, অর্থনীতিবিদ যেটা ঠিক বলে মনে করেন, তাঁর সেটাই করতে বলা উচিত, বাস্তব পরিণাম যা-ই হোক না কেন। তর্কটা কঠিন।

এই প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের। ধরা যাক, আরসিটির মাধ্যমে দেখা গিয়েছে যে, একটা দরখাস্তের ফর্ম সাদা-কালো না হয়ে রঙিন হলে বেশি ভাল কাজ হয়। সে ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় রঙিন ফর্ম দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতেই পারে, তাতে কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু শিক্ষকদের আর্থিক উৎসাহ, পেনশনের বিকল্প বন্দোবস্ত, টিকা দেওয়ার বিকল্প আয়োজন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কেবল সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ করতে গেলে বিপদ হতে পারে। মোদ্দা কথা হল, গবেষণা একটা বৈজ্ঞানিক কাজ, নীতিগত পরামর্শ হল রাজনৈতিক ব্যাপার।

আরসিটি মডেলে উৎসাহীরা কেউ কেউ বলতেই পারেন, নীতি রচনা থেকে রাজনীতিকে বাদ দেওয়ার জন্য, আদর্শ, বিশ্বাস ইত্যাদির কবল থেকে সরকারি নীতিকে আড়াল করার জন্যই তো আরসিটি দরকার। তাঁরা হয়তো চাইবেন, বিশেষজ্ঞরা নীতিকারদের পরামর্শ দিন। কিন্তু এ ভাবে রাজনীতিকে এড়ানো যায় না। নীতিগত সিদ্ধান্তে মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকারের প্রশ্ন থাকবেই। যেটা কার্যক্ষেত্রে ঘটবে তা হল, নীতিগত সিদ্ধান্তগুলিকে জনপরিসরে যাচাই করার দায় থেকে নীতিকাররা অব্যাহতি পাবেন। তাঁরা বলবেন, এ নীতি তো বিশেষজ্ঞরা ঠিক করে দিয়েছেন, এ নিয়ে আর কার কী বলার থাকতে পারে! ভারতে এখন এটাই ঘটছে। উত্তরোত্তর নীতি স্থির হচ্ছে জনপরিসর থেকে দূরে— অর্থ মন্ত্রক, পিএমও, নীতি আয়োগের অন্দরমহলে। আমি এটাকে ভাল বলে মনে করি না। মনে রাখতে হবে,

ভারতে গরিবরা যেটুকু যা পেয়েছেন, নির্বাচনী রাজনীতির মধ্যে দিয়েই পেয়েছেন। রাজনীতিমুক্ত সামাজিক নীতি বলে যদি কিছু থাকে, সেটা দরিদ্র মানুষের পায়ের তলা থেকে এই রাজনৈতিক জমিটুকু সরিয়ে নেবে।

আরসিটি বা বৃহত্তর অর্থে সাক্ষ্যপ্রমাণ-ভিত্তিক নীতির মূল্য অনস্বীকার্য। সরকারি নীতিতে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভূমিকা বাড়ানো যদি উদ্দেশ্য হয়, সেটা নিশ্চয়ই ভাল। কিন্তু এই পথে যথার্থ সুফল পেতে চাইলে আমাদের মনে রাখতে হবে— সাক্ষ্যপ্রমাণ কেবল আরসিটির ব্যাপার নয়, বোধ কেবল সাক্ষ্যপ্রমাণের ব্যাপার নয় এবং নীতি কেবল বোধের ব্যাপার নয়।

অর্থনীতিবিদ, রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক। সোশ্যাল সায়েন্স অ্যান্ড মেডিসিন-এ প্রকাশিত প্রবন্ধের পরিমার্জিত রূপ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE