ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ হাজার পরিবার।
সোজা কথাটি সোজা করিয়াই বলা ভাল। কেরলের জন্য বিদেশি রাষ্ট্রগুলি ত্রাণ দিতে চাহিলে তাহা না লওয়ার সিদ্ধান্ত একটি নির্বোধ প্রবঞ্চনামাত্র। যুগপৎ আত্মপ্রবঞ্চনা এবং পরপ্রবঞ্চনা। নিশ্চয়ই ভারত সরকার আশা করিতেছে না যে এই একটি-দুইটি ত্রাণসাহায্য লইতে অস্বীকার করিলেই আন্তর্জাতিক সমাজে ভারতের সম্মান বাড়িবে, ভারতকে বেশ একটি মহাশক্তি হিসাবে দেখা শুরু হইবে, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হইবার প্রতিযোগিতায় ভারত কয়েক কদম আগাইয়া যাইবে। নিশ্চয়ই ভারত সরকার জানে যে ‘উহাদের সাহায্যের দরকার কী, আমাদের তো অনেক আছে’ শীর্ষক মন্তব্যের মধ্যে সত্যের অপেক্ষা মিথ্যার শতাংশ বেশি। নিশ্চয়ই বর্তমান এনডিএ সরকার ইহাও জানে যে প্রতি ক্ষেত্রে প্রতি সুযোগে তাহারা পূর্বতন ইউপিএ সরকারের পদচিহ্ন অনুসরণ করিয়া চলে না, সুতরাং ২০০৪ সালের পূর্বদৃষ্টান্তে হাত-পা বাঁধা বলিয়া নিজের অসহায়ত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে পারে না! রাজনৈতিক ও নৈতিক মানদণ্ডে যে বাহিরের দেশের ঋণ গ্রহণ করা ও ত্রাণসাহায্য স্বীকার করার মধ্যে বহু যোজন দূরত্ব, তাহা বুঝাইয়া বলিবার অপেক্ষা রাখে না। তাহা হইলে এই সম্পূর্ণ অকারণ বাড়াবাড়ির কারণ কী? বাহির হইতে ত্রাণ লইলে দেশের ভিতরের অপারগতা প্রকট হইয়া পড়িবে, এইটুকুই? না কি, দুর্জনে যেমন বলিতেছে, কেরল রাজ্য সরকারের সহিত কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক রঙের পার্থক্যের কারণেই এই অসহযোগ? এমন প্রশ্ন উচ্চারণ করিতে হয়, ইহাও কম দুঃখের এবং লজ্জার নহে।
কারণ যাহাই হউক, সত্যই যদি ত্রাণ প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকে, তবে বলিতে হইবে স্বাধীন দেশের ইতিহাসে আর একটি লজ্জার মুহূর্ত যোগ হইল। কেরলের এ বারের বন্যা এক শত বৎসরে ইতিহাসে অভূতপূর্ব। কতগুলি দশক লাগিবে এই রাজ্যের আবার নিজের পায়ে খাড়া হইয়া দাঁড়াইতে, বলা কঠিন। কেন্দ্রীয় সরকার এখনও অবধি যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়াছে, তাহা অপ্রতুল। রাষ্ট্রের দারিদ্র এই ব্যয়কুণ্ঠার একমাত্র কারণ বলিয়া মানা কঠিন। প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ও কেরলে প্রতিশ্রুত সহায়তার পরিমাণ পাশাপাশি রাখিলে অতি বড় বিজেপি-প্রবরও লজ্জায় পড়িবেন, ফলে কুযুক্তির আড়াল খুঁজিবেন। সেই সকল কুযুক্তির মধ্যে অবশ্যই থাকিবে ২০০৪ সালে সুনামির পর ইউপিএ সরকারের বিদেশি ত্রাণ অস্বীকারের দৃষ্টান্ত— যাহা নাকি অবশ্যমান্য!
অথচ চৌদ্দ বৎসর আগেকার ওই দুর্ভাগ্যজনক দৃষ্টান্তটি মানিবার দরকার যে নাই, তাহা বর্তমান সরকারের আমলে তৈরি জাতীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকল্পনা (এনডিএমপি, ২০১৬) নিজেই বলিতেছে। সেখানে বলা আছে ভারত নিজে ত্রাণ চাহিবে না, কিন্তু কোনও রাষ্ট্র যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত ভাবে পুনর্বাসনের খাতে অর্থসাহায্য করিতে চায়, তাহা বিবেচনাযোগ্য। প্রসঙ্গত যদি এই বিষয়ে কোনও আইনি বাধাও থাকে, তাহাও অতিক্রম করা সম্ভব আইনের পরিবর্তনে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে আইনের মাহাত্ম্য জনকল্যাণের খাতিরেই, জনকল্যাণ আটকাইবার জন্য আইন ব্যবহার গণতন্ত্রের আদর্শ বা উদ্দেশ্য হইতে পারে না। রাজনীতিক বা কূটনীতিকের দরকার নাই, সাধারণ নাগরিকও বুঝিতে পারেন যে, যদি সত্যই এই একটি ক্ষেত্রে ত্রাণ না লইবার কারণেই ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জে প্রভাব-প্রতিপত্তির দৌড়ে অনেকটা আগাইয়া যাইতে পারিত, সে ক্ষেত্রেও বলিতে হইত, মানবজীবনের মূল্য গনিয়া, নাগরিক দুর্দশার দাম ধরিয়া রাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানো অত্যন্ত অনৈতিক। এত বড় বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়াইয়া ভারতের নাগরিক সমাজ নির্বোধ কূটনীতি চাহে না। প্রথমত ও প্রধানত, মানবিকতা চাহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy