Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাঙালি এবং আইএএস

সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিসে পশ্চিমবঙ্গের ‘নিজস্ব’ অফিসার থাকাটা কেন আবশ্যক? এর একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, রাজ্যের প্রথম সারির মেধাবী ছেলেমেয়েদের রাজ্যের এবং দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পাওয়া উচিত।

বিরল: সন্দীপ ঘোষ, র‌্যাঙ্ক ৬৭, আইএএস ’১৫

বিরল: সন্দীপ ঘোষ, র‌্যাঙ্ক ৬৭, আইএএস ’১৫

অতনু পুরকায়স্থ
শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৭ ১২:৩০
Share: Save:

প্রশ্ন উঠতে পারে, সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিসে পশ্চিমবঙ্গের ‘নিজস্ব’ অফিসার থাকাটা কেন আবশ্যক? এর একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, রাজ্যের প্রথম সারির মেধাবী ছেলেমেয়েদের রাজ্যের এবং দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পাওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, নিজের রাজ্যে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আধিকারিকরা জাতীয় স্তরে রাজ্যের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং মানুষের ভাবনা বুনে দিতে পারলে এই রাজ্য সম্পর্কে ধারণা জাতীয় স্তরে আরও স্বচ্ছ হবে এবং কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করা আরও সুবিধাজনক হবে। তাতে আখেরে রাজ্যেরই লাভ। তৃতীয়ত, ভারত বহু সংস্কৃতির সমাহার। রাজ্য অঞ্চল ভেদে একই সমস্যার চরিত্র আলাদা, তার সমাধানের উপায়ও ভিন্ন। ফলে প্রশাসনিক কোনও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গোটা দেশে একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকবে, এটা সচরাচর অসম্ভব। জাতীয় প্রশাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজ্য স্তরে কাজ করাই কাম্য, কিন্তু প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য, কিছু সমস্যা এবং একটা নির্দিষ্ট ধারা থাকে। তাই রাজ্যের ‘নিজস্ব’ সিভিল সার্ভিস অফিসার থাকলে তাঁরা কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই স্তরের চাহিদার মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করে কাজ করতে পারেন। চতুর্থত, রাজ্যের ‘নিজস্ব’ অফিসাররা উদাহরণ হয়ে থাকবেন, যারা পরীক্ষা দেবে বা ভবিষ্যতে যারা সিভিল সার্ভিসকে পেশা হিসেবে নিতে চায়, তাদের কাছে। দেশ এবং দেশের নাগরিকের জন্য কাজ করাটা কিন্তু সত্যিই একটা গর্বের ব্যাপার। একটা কলমের আঁচড়ে বহু লোকের জীবনে উন্নতি সাধন করার সুযোগ থাকে। জীবনে রাজকর্ম এবং রাজধর্ম পালন করার সন্তোষ মেলে।

এখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। প্রতিটি রাজ্যের আয়তন ও জনসংখ্যার নিরিখে এআইএস বা সর্বভারতীয় সার্ভিসগুলির প্রতিটিতেই অনুমোদিত পদের এক-তৃতীয়াংশ রক্ষিত থাকে রাজ্যের ‘নিজস্ব’ অফিসারের জন্য। এবং রাজ্যে কাজ করলেও এআইএস আধিকারিকদের বেতন ও অন্যান্য খরচ কেন্দ্রীয় সরকার মেটায়। ঘটনা হল, ২০১৬-র সিভিল লিস্ট অনুযায়ী ‘নিজস্ব’ অফিসারের জন্য বরাদ্দ কোটা পশ্চিমবঙ্গ ভর্তি করতে পারছে না, বহু কোটা ফাঁকা থেকে যাচ্ছে, যা অন্য রাজ্যের অফিসার দিয়ে ভর্তি করা হচ্ছে। ১ জানুয়ারি ২০১৬-র হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে ‘নিজস্ব’ অফিসার ছিলেন মাত্র ২৯ জন। অথচ নিজস্ব অফিসারের সংখ্যায় অন্যান্য রাজ্য অনেক এগিয়ে রয়েছে। বিহারে ৭৩, ওডিশায় ৩৬, হরিয়ানায় ৩৭, কেরলে ৪৫, পঞ্জাবে ৩৫। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে ছোট অনেক রাজ্যের নিজস্ব অফিসারের সংখ্যা এ রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব অফিসারদের তুলনায় এ রাজ্যে উত্তরপ্রদেশের অফিসারদের সংখ্যা (৩৮) বেশি। ফলে, রাজ্য যে কেবল চাকরির সুযোগ হারাচ্ছে তা-ই নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের খরচে এ রাজ্যের ছেলে-মেয়েদের উচ্চপদে নিয়োগের সুযোগও হাতছাড়া হচ্ছে।

একটা ব্যাপার ভাল করে বোঝা দরকার। সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতার বণ্টন যে ভাবে হয়ে থাকে, সেখানে রাজ্যের ‘নিজস্ব’ অফিসার দিল্লিতে বা নিজের রাজ্যে কাজ করার গুরুত্ব বিস্তর। একই রকম ভাবে, জেলা স্তরে প্রতিটি প্রকল্প সময় মতো ও ঠিকঠাক সম্পাদন করাটাও খুব জরুরি। এ ছাড়া রাজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরে যে সব অফিসাররা কাজ করেন, তাঁরা রাজ্যের বিভিন্ন সমস্যা বুঝে, সেই মতো সমাধানের চেষ্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলে কেন্দ্রীয় স্তরে যখন রাজ্যের জন্য কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তখন সেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজ্যের নিজস্ব অফিসার থাকলে ভাল হয়। এবং সেই জন্যই আইএএস অফিসারদের কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই জায়গাতেই নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে কাজ করার সুযোগ আছে।

এই মুহূর্তে ভারতের প্রশাসনিক মানচিত্রে রাজ্যের প্রতিনিধিত্বের যা দুর্দশা, তা ঠিক করতে হলে রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নীতি-নির্ধারক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং অভিভাবকদের খুব গভীর ভাবে ভাবতে হবে এবং এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে সময়বাঁধা কর্মসূচি নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে। একটি সুপরিকল্পিত রূপরেখা তৈরি করে, সেই অনুযায়ী স্কুলের উঁচু ক্লাস থেকে ছাত্রদের তৈরি করতে হবে। আরও একটি ব্যাপার নজর করা দরকার, যাতে প্রার্থীরা ২২ থেকে ২৪ বছর বয়সের মধ্যে এই চাকরিতে যোগ দিতে পারে। তা হলে তারা কম বয়স থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ঠিক সময়ে কেরিয়ারের উচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারবে।

পশ্চিমবঙ্গের মেধাবী ছাত্রদের আইএএস-এ যোগ দিতে না চাওয়ার পিছনে একটা বড় কারণ অনুপ্রেরণার অভাব। যে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় বসে চাকরি পেতে চায়, তাদের এই পরীক্ষার জন্য স্কুলের উঁচু ক্লাস থেকেই তৈরি করা দরকার। এবং সেই জন্য আগে অভিভাবকদের নিশ্চিত হতে হবে যে তাঁরা চান, তাঁদের ছেলেমেয়েরা প্রশাসনিক কাজে যোগ দিক। সেই মতো ছেলেমেয়েদের উদ্বুদ্ধ ও প্রস্তুত করতে হবে। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো যায়, যাতে তাঁরা এই চাকরির মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে পারেন। কেরিয়ার হিসেবে সিভিল সার্ভিস কতটা আকর্ষণীয়, সেটা ছাত্রছাত্রীদের খুব কম বয়স থেকে বোঝাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি যদি এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করে, তবে ভবিষ্যতে ভাল ছাত্ররা এই পেশার দিকে ঝুঁকবে। অন্য দিকে, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে ছাত্রছাত্রীরা আইএএস তথা সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় সফল হয়েছেন, তাদের সম্পর্কে জোরদার প্রচার করা দরকার। সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী সফল পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিতে পারেন,তাতে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা প্রভূত উৎসাহ পাবেন।

একটা সমাজ তার পথিকৃৎদের কাছ থেকেই এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাংলা যে প্রায় সবার চেয়ে এগিয়ে ছিল, তার অন্যতম কারণ হল বাংলা থেকে বহু পথিকৃৎ তৈরি হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকেই প্রশাসনে যোগ দিয়েছিলেন, আমলা ছিলেন, উন্নতির দিশা দেখিয়েছিলেন এবং দেশের ভবিষ্যৎ তৈরির রূপকার হয়েছিলেন। সিভিল সার্ভিসের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ গত তিরিশ বছর ধরে যে ভাবে পিছিয়ে পড়েছে, তা শোধরাতে একটি সচেতন উদ্যোগ অবিলম্বে জরুরি। ভারতের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে এই উদ্যোগ জরুরি।

(শেষ)

অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE