আইনজীবী সইফুল মুলুক।—ছবি এএফপি।
আসিয়া বিবিকে রক্ষা করিয়াছেন, সেই কারণে প্রাণসংশয় হইয়াছে পাকিস্তানের আইনজীবী সইফুল মুলুকের। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বুকে খ্রিস্টান মহিলাকে ধর্মদ্রোহের শাস্তি হইতে বাঁচাইবার প্রচেষ্টা যে কত বড় অপরাধ, ইহা আইনজীবীকে বুঝাইয়া দিতে তৎপর কট্টরপন্থীগণ। ফলত দেশ ছাড়িয়াছেন সইফুল, এবং তাঁহার পরিবারকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিবার অনুরোধ করিয়াছেন সরকারকে। পলায়ন যে অহেতুক নহে, তাহার প্রমাণ: ধর্মদ্রোহে অভিযুক্তের পক্ষাবলম্বনের ‘অপরাধ’-এ ইতিপূর্বে দুই প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি খুন হইয়াছেন। এবং, পাকিস্তান সরকারের জোট শরিক তেহরিক-ই-লাবাইক দাবি জানাইয়াছে, যে বিচারপতি ও আইনজীবী আসিয়ার পক্ষে আইন প্রয়োগ করিয়া তাঁহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছেন, মৃত্যুদণ্ড হউক তাঁহাদেরও। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও আসিয়ার মুক্তি রুখিয়া দিয়াছে তাহারাই।
সত্যের পক্ষে ওকালতি করিলে তাহা যে গণের বিপক্ষে যাইতে পারে এবং চরমতম সঙ্কট ঘনাইয়া আসিতে পারে, ইহা অজানা নহে। হেনরিক ইবসেনের বিখ্যাত নাটক এনিমি অব দ্য পিপল-এ জনপ্রিয় ধারণার বিপরীতে প্রসাধনস্থলে দূষিত জলের প্রসঙ্গ তুলিয়া ধরায় জনগণের চোখে অপরাধী হইয়াছিলেন ডাক্তার টমাস স্টকমান। যথাযোগ্য শাস্তি ভোগ করিতে হইয়াছিল তাঁহাকে। অতএব গণ অথবা সত্যকে বাছিতে হইবে, ইহা অনেক সময়েই বাস্তব সত্য। বহু ক্ষেত্রেই এই গণ-উন্মাদনার সহিত ধর্মবিশ্বাসের একটি গূঢ় সংযোগ থাকে, অধুনা যাহার সহিত গূঢ়তর সংযোগ ঘটিয়াছে রাজনীতির। স্মরণে আসিতে পারে, কাঠুয়া গণধর্ষণ মামলায় নিহত শিশুর পক্ষে কর্মরত আইনজীবী জানাইয়াছেন, তাঁহাকে ক্রমাগত ধর্ষণ ও খুনের হুমকি দেওয়া হইতেছে। এই দেশেও ধর্ষণের বিপক্ষে সওয়াল করিলে ধর্ষিত হইবার আশঙ্কায় ভুগিতে হয়! নিন্দুকেরা বলিতে পারেন, ভারত-পাকিস্তানকে মিলাইবার একমাত্র পন্থা তবে ধর্মীয় উন্মাদনা।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির একটি বড় কারণ রাষ্ট্রের ভূমিকা। যাঁহারা হীনবল তাঁহাদের আশ্রয় হইবে রাষ্ট্র, ইহাই কাম্য। চারিপাশের প্রতিকূলতাকে অস্বীকার করিয়া যে ব্যক্তি সত্যের পক্ষে দাঁড়াইয়াছেন, তাঁহাকে আরও শক্তির জোগান দেওয়া রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। অথচ সহযোগিতা এবং সুরক্ষার পরিবর্তে আক্রমণের যে ঢেউ উঠিতেছে, তাহাতে রাষ্ট্রের চালক দল বা গোষ্ঠীগুলির প্রশ্রয় আছে, এমন সংশয় অতি প্রবল— পাকিস্তানে যেমন, ভারতেও তেমনই। সইফুলের বক্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলিয়াছেন, আসিয়ার নিমিত্ত তাঁহার প্রাণধারণ জরুরি, কারণ তাঁহার কেহ নাই। আইনজীবী বুঝিয়াছেন, ধর্মীয় ক্ষমতার সম্মুখে ন্যায়বিচারের স্বাভাবিক নিয়ম অচল। ইমরান খানের সরকার ধর্মের ক্ষমতা জানে, অতএব ন্যায়-অন্যায়ের পরোয়া না করিয়া তেহরিক-ই-লাবাইকের সহিত পাঁচ দফার সন্ধি করিয়া লইয়াছে। সইফুল দেশ ছা়ড়িলেও আসিয়া বিবি তাহা পারিবেন না— স্পষ্ট করিয়াছে সেই চুক্তিপত্র। এমনকি, মুক্তির নির্দেশকেও চ্যালেঞ্জ জানাইবে কট্টরপন্থীগণ। প্রশ্রয়ে পিছাইয়া ছিল না ভারতীয় প্রশাসনও। জম্মু ও কাশ্মীরের মন্ত্রী চন্দ্র প্রকাশ গঙ্গা হইতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ— অভিযুক্তদের ‘বিচার’ মিলিবার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করিয়াছিলেন। স্পষ্টতই, ধর্মান্ধতার রাজনীতি সীমানা মানে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy