দেশের নেতার হাতে সকল সমস্যার চাবি নাই। সমাধানের চেষ্টায় তাঁহার ভ্রান্তি হইবে, তাহাও প্রত্যাশিত। কিন্তু ভ্রান্ত, অসার নীতিকে নূতন প্রকল্প বলিয়া পেশ করিলে দেশবাসীর সহিত প্রবঞ্চনা করা হয়। নরেন্দ্র মোদী চাষির রোজগার বাড়াইবার উদ্দেশ্যে তিনটি প্রকল্পকে একত্রে ‘প্রধানমন্ত্রী অন্নদাতা আয় সুরক্ষা যোজনা’ নামে ঘোষণা করিলেন। সংক্ষেপে তাহার নাম ‘পিএম-আশা।’ এই তিন পদ্ধতির একটি (ব্যবসায়ীর দ্বারা ন্যূনতম মূল্য প্রদান) অজ্ঞাত, কারণ তাহা পূর্বে রূপায়িত হয় নাই। বাকি দুইটি প্রকল্পের সাফল্য বিচার করিলে আশা জাগিতে চাহে না। ন্যূনতম মূল্যে সরকারি খরিদের রীতি অতি পুরাতন। তাহার সীমাবদ্ধতা এই যে, চাল ও গম ভিন্ন কোনও ফসল কিনিবার, মজুত করিবার এবং বণ্টনের পরিকাঠামো প্রায় কোনও রাজ্যে নাই। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে কৃষক বিক্ষোভের মুখে কেন্দ্র ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ডাল কিনিয়াছে, কিন্তু তাহার ব্যবহারের উপায় স্থির করিতে পারে নাই। নিলাম ডাকিয়া ডাল বিক্রয় করিবে, না কি দেশের দরিদ্রতম জেলাগুলিতে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিলি করিবে? গণবণ্টনের অধীনে ডাল সরবরাহের ব্যবস্থা করিতেই লাগিবে আট হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে ‘ন্যূনতম মূল্যে সকল প্রকার ফসল ক্রয়’ প্রকল্পের ঘোষণা অর্থহীন। ‘কিনিব’ বলিলেই হয় না, তাহার জন্য অর্থ বরাদ্দও করিয়াও লাভ নাই। মজুত, বণ্টন, বিক্রয়ের পরিকাঠামো কি জাদুবলে গড়িয়া উঠিবে?
দ্বিতীয় প্রকল্প, মূল্যে পার্থক্যের পূরণ। ডাল, তৈলবীজ প্রভৃতি ফসলের বাজারদর সহায়ক মূল্যের চাইতে কম হইলে সরকার ক্ষতি পুষাইয়া দেবে। ওই দুই মূল্যের যাহা পার্থক্য, সেই টাকা জমা পড়িবে চাষির অ্যাকাউন্টে। প্রস্তাবটি শুনিতে ভাল, কিন্তু ইহা মধ্যপ্রদেশে ‘ভাবান্তর ভুগতান যোজনা’ নামে গত খরিফ মরসুমে রূপায়িত হয়। তাহার সমস্যা ইতিমধ্যেই প্রকট। ব্যবসায়ীরা ষড়যন্ত্র করিয়া ফসলের দাম অত্যন্ত কমাইয়াছে, এবং প্রকল্পের সময়সীমা পার হইলে চড়া দামে বিক্রয় করিয়াছে। চাষি হয়তো সরকারের নিকট সহায়ক মূল্যটুকু পাইয়াছে, কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে ব্যবসায়ী। প্রচুর অর্থব্যয় করিয়াও সরকার ফসলের দাম প্রভাবিত করিতে পারে নাই। এ বৎসর মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চহ্বান বিবিধ ফসলকে ওই প্রকল্প হইয়া অপসারিত করিয়াছেন। এমন সমস্যা-সঙ্কুল প্রকল্প কী ভাবে জাতীয় নীতি হইতে পারিল?
কেবল প্রকল্পগুলির সার্থকতায় সংশয়টুকুই নহে। আপত্তি আরও মৌলিক। এই তিনটি প্রকল্পেরই উদ্দেশ্য, ফসলের একটি নির্দিষ্ট মূল্য নিশ্চিত করা। সেই মূল্য কেবল উৎপাদন ব্যয়ের দ্বারা নির্ধারিত, বাজারে চাহিদার সহিত তাহার যোগ নাই। জাতীয় স্তরে সকল ফসলের জন্য যদি সত্যই এই নীতি প্রয়োগ করা হয়, তবে কৃষির বাজারে চাহিদা-জোগানের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হইবে। তাহা কৃষির উন্নয়নের অন্তরায় হইবে, রাজকোষেরও সঙ্কট দেখা দিবে। তেলঙ্গানা এবং কর্নাটক কিন্তু এই পথ লয় নাই। ওই দুই রাজ্য একর প্রতি উৎপাদন খরচে ভর্তুকি দিয়া চাষির সহায়তা করিতেছে। তাহাতে চাষির চাপ কমিবে, বাজারের ভারসাম্য নষ্ট হইবে না, ফসলের বৈচিত্রও কমিবে না। মোদী সরকার কি এই বিকল্প বিবেচনা করিয়াছিল? তেমন শোনা যায় নাই। সন্দেহ হয়, ঘোষণার আড়ম্বর আবারও মূল উদ্দেশ্যকে পরাহত করিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy