Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: রাবণ ও অন্যান্য

রাবণের পিতা ছিলেন ব্রাহ্মণ বিশ্রবা ঋষি। মা রাক্ষসকন্যা কৈকসী। পছন্দ করে বিশ্রবা মুনিকে বিবাহ করেছিলেন। ব্রাহ্মণসন্তান রাবণ ছিলেন এক জন সংস্কৃতজ্ঞ, সুপণ্ডিত, মহাপুরোহিত, চার বেদ-সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে তাঁর অনায়াস দখল।

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

প্রসঙ্গ ‘জাগরণ এ রাজ্যেও’ (১১-১১) শীর্ষক চিঠি। পত্রলেখকের বক্তব্য অনুযায়ী “দলিত আদিবাসীদের অনেকগুলি সংগঠন নাকি হিন্দুত্ব খুঁজে পেয়েছে’’ পুরোহিত তন্ত্র, হিন্দু দেবদেবী পুজো, বিষ্ণুর দশাবতার প্রভৃতির মধ্যে। তাই এগুলিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা দরকার। কিন্তু ‘ঝেঁটিয়ে বিদায়’-এর জন্যে রাবণসংস্কৃতির বিস্তারের দরকার কেন পড়ল সেটা মালুম হল না? আরও লিখেছেন, ‘‘রাবণবধে শাস্ত্রাচারী হিন্দু মন তৃপ্ত হতে পারে, যুক্তিবাদী মানবতাবাদী দলিত হৃদয় নয়’’ (দলিতরা কি হিন্দু নন?)।

রাবণের পিতা ছিলেন ব্রাহ্মণ বিশ্রবা ঋষি। মা রাক্ষসকন্যা কৈকসী। পছন্দ করে বিশ্রবা মুনিকে বিবাহ করেছিলেন। ব্রাহ্মণসন্তান রাবণ ছিলেন এক জন সংস্কৃতজ্ঞ, সুপণ্ডিত, মহাপুরোহিত, চার বেদ-সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে তাঁর অনায়াস দখল। শিবভক্ত রাবণ শিবের পুজো না করে কখনও আহার করতেন না। মহাজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও রাবণ ছিলেন রাক্ষসগুণসম্পন্ন, বীরদর্পী, অহঙ্কারী। রাবণ তাঁর দাদার কাছ থেকে স্বর্ণলঙ্কা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। রাবণের অনেক রানি ছিলেন, যাঁদের অনেককেই রাবণ, চলতি কথায় ‘তুলে এনেছিলেন’। রাবণের সাঙ্গপাঙ্গ খর, দূষণদের কাজই ছিল যজ্ঞ ধ্বংস করে মুনিঋষিদের হত্যা করা। এ প্রসঙ্গে বাল্মীকি রামায়ণে রাবণের প্রধান মহিষী মন্দোদরীর বিলাপ উল্লেখযোগ্য— মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র “যজ্ঞ ধ্বংস, ধার্মিকদের হত্যা, আর দেব দানব, মানব কন্যা অপহরণ পাপের জন্যে আপনার মৃত্যু হল।’’ তা, পরস্ত্রী অপহরণকারী এমন ব্যক্তি কী ভাবে তথাকথিত ‘যুক্তিবাদী’ ‘মানবতাবাদী’দের প্রেরণা হলেন, তা বোধগম্য হল না।

লেখক লিখেছেন ‘দলিত’ আদিবাসীরা নাকি দৈত্য, দানব, অসুর, রাক্ষসদের নিজ পিতৃপুরুষ মনে করেন— যাদেরকে ‘বহিরাগত’ আর্যরা হারিয়ে দিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি ‘জোর’ করে চাপিয়ে দিয়েছিল। পুরাণে দেখা যাবে, দেবতা এবং দানব উভয়ের মাতা আলাদা হলেও পিতা এক জনই: মহর্ষি কশ্যপ। একই সময়ে উভয়দের জন্ম। দেবতারা ভাল গুণগুলি পেলেও (ব্যতিক্রম রয়েছে) দানবেরা দুর্গুণের অধিকারী হয় (ব্যতিক্রম রয়েছে)। এদের কাজই ছিল ধার্মিকদের অকারণ হত্যা, অত্যাচার করা। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মথুরার যাদব বংশীয় রাজা উগ্রসেন, তাঁর ভাই দেবক, দেবকের কন্যা দেবকী, দেবকীপুত্র কৃষ্ণ। এঁরা কেউই অসুর বংশীয় নন। অথচ কংসকে অসুর বলা হয়। কারণ তিনি তার পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে নিজে রাজা হন। বহু শিশুহত্যা করেন। চণ্ড মুণ্ড, শুম্ভ নিশুম্ভ, মহিষাসুর, হিরণ্যকশিপু, রাবণ, মধু, কৈটভ— এঁরা কেউই নিপীড়িত, অবহেলিত, অসহায় ছিলেন না, বরঞ্চ বিত্ত-বৈভবে অনেকে দেবতাদের থেকেও ঐশ্বর্যশালী ছিলেন। এঁদের কাজই ছিল তপস্যা করে লেখক কথিত ‘আর্য’ দেবতা ব্রহ্মার কাছ থেকে বর আদায় করা, তার পরে দেবতার বলে বলীয়ান হয়ে সমাজে অত্যাচার করা, নিরীহ নিরপরাধীদের হত্যা করা। ভস্মাসুর তো শিবের কাছে বর পেয়ে শিবকেই হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন, বিষ্ণুর কৌশলে শিব কোনও রকমে রক্ষা পান। আবার ব্যতিক্রমও ছিলেন, যেমন দানবীর বলী, প্রহ্লাদ প্রমুখ। তাঁরা উভয়েই বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। তাই কেউ মনে করলেই কিছু হয়ে যায় না। হাতি মনে করলেই তো আর ডাইনোসরকে তার পিতৃপুরুষ করতে পারে না। বাস্তবে ‘দেব’ ও ‘দৈত্য’ গুণবাচক শব্দ।

লেখক আর্য-অনার্য নিয়ে কিছু কথা বলেছেন, তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। তবুও জানাতে চাই, ভারতীয় ইতিহাসটাই দাঁড়িয়ে আছে ‘হয়তো’, ‘বোধ হয়’, ‘মনে করা হয়’, ‘ধরে নেওয়া হয়’ শব্দগুলির ওপরে। স্বয়ং ম্যাক্সমুলার সাহেব, ১৮৫৯ সালে প্রথম আর্য-অনার্য তত্ত্ব আমদানি করলেন, তাঁর লেখা শুরুই হয়েছে 'supposing' শব্দের মাধ্যমে। অথচ ‘পুরাণ’ ঘাঁটলে দেখা যায় তথাকথিত আর্য ব্রাহ্মণ বিয়ে করছেন শূদ্র মৎস্যকন্যাকে, ক্ষত্রিয় ভীম বিবাহ করছেন রাক্ষসী হিড়িম্বাকে, অথবা অর্জুন নাগকন্যা উলূপীকে, এঁদেরকে সমাজ একঘরে করেছিল এমন তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। চণ্ডাল গুহক রামচন্দ্রের পরম মিত্র ছিলেন। রাবণকে নিয়ে লেখক কথিত যে সংগঠনগুলি ‘লড়াই’-এ নেমেছে তারা জেনে রাখুক, রাবণের বিরুদ্ধে রামচন্দ্রের যারা সহায় হয়েছিল, সেই বনবাসী, গিরিবাসী হনুমান, জাম্বুবান, সুগ্রীবেরা রাবণের থেকে অনেক বেশি ‘অনার্য’ ছিল। আর রামায়ণ তো রচিতই হয়েছিল অনার্য ব্যাধ কর্তৃক। মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব স্বয়ং ছিলেন শূদ্রমাতার সন্তান। ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী ‘যে গৌরী সেই কালী’।

ইংরেজরা কখনওই চায়নি যে ভারতীয় সমাজে, জাতীয় চরিত্রের বিকাশ ঘটুক। যে সময় ভারতীয় ঋষিগণ বেদ-উপনিষদের চর্চা করছেন, সেই সময় তাদের পূর্বপুরুষরা অসভ্য উলঙ্গ হয়ে কাঁচা মাংস চিবিয়েছেন, এটা ইংরেজদের কাছে অসহ্য ঠেকেছিল। তাই মেকলীয় তত্ত্বের মাধ্যমে, ম্যাক্সমুলারের নেতৃত্বে তৈরি হল আর্য-অনার্য তত্ত্ব। শিব, কালী, মনসা, রাবণ প্রমুখকে দেখানো হল অনার্য হিসেবে, আর ইন্দ্র, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, দেবী দুর্গা প্রমুখদের আর্য সাজিয়ে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রগুলিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো হল। যে ‘তত্ত্ব’গুলি পরবর্তী কালে মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদগণ কর্তৃক পরিপুষ্ট হয়েছে।

তাই লেখক বর্ণিত তথাকথিত দলিত আদিবাসী সংগঠন— যারা কিনা রাবণসংস্কৃতির বিস্তার চায়, তাদের প্রতি বিনম্র নিবেদন, সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে ‘সাংস্কৃতিক লড়াই’ না করে একে অপরের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কী ভাবে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ানো যায়, সে চেষ্টা করুক। মনে রাখতে হবে, যে-ইতিহাসবিদ, নৃতত্ত্ববিদদের ভরসায় আর্যদের অনুপ্রবেশকারী বলছেন, তাঁরাই কিন্তু ভারতীয় ‘আদিবাসী’দের, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, মঙ্গোলিয়া থেকে ভারত-আগত বলে উল্লেখ করেছেন।

মন্দার গোস্বামী

খাগড়া, মুর্শিদাবাদ

বাদ, বিবাদ

রাবণ কী ভাবে দলিত সমাজের প্রতিভূ হতে পারেন? যাদের অসুর বলি তাঁরাও বহিরাগত আর্য, তাঁরা বৈদিক মতবাদী আর্য নন। স্বর্গলোকে, সম্ভবত হিন্দুকুশ পর্বতের ও-পারে, দুই বৈমাত্রেয় ভাই সুর এবং অসুরের যুদ্ধে অসুরেরা পরাজিত হয়ে এই ভারতভূমিতেই পালিয়ে আসেন এবং তাঁরাই প্রথম ভারত দখলকারী বহিরাগত গোষ্ঠী। এঁরাই চন্দ্র-বংশীয় আর্য গোষ্ঠী। বহু বছর ধরে এঁরাই চালান শাসন, উৎপীড়ন। তার পর আসেন বৈদিক আর্যেরা। এঁরা ছিলেন একেশ্বরবাদী। ঋগ্বেদের দশম খণ্ড অবধি ছিল এঁদের ধর্মগ্রন্থ। এঁদের কোনও দেবদেবী ছিল না। ঋগ্বেদের বাকি অংশ এবং অন্য‍ তিন বেদ রচনা হয় ভারতের মাটিতেই। এই সব খণ্ডেই উল্লেখ আছে দেবদেবীর, যাঁরা পুজো পাওয়ার যোগ্য। অনার্য শিবই ভারতবাসীদের মহাদেব। দ্রাবিড় সভ্যতা থেকেই শিবের পুজো প্রচলিত। আর্য সভ্যতার সঙ্গে এ পুজোর কোনও সম্পর্ক নেই। প্রকৃত দুর্গা, অর্থাৎ মহেশ্বরী দুর্গা, অর্থাৎ হিমালয় গিরি ও মেনকার কন্যা উমা বা গৌরীর পুজোও আদি ভারতীয়। কাত্যায়নী দুর্গা একেবারেই ভিন্ন, তাঁকে দেবতারা সৃষ্টি করেছিলেন। যদিও এখন দুই দুর্গা মিলেমিশে এক। অাবার, বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গাপুজোর কোনও উল্লেখ নেই, অথচ কবি কৃত্তিবাস ব্রাহ্মণ রাবণকে গৌরবান্বিত করতেই রামচন্দ্রকে দিয়ে দুর্গাপুজো করিয়েছেন, এবং অবিশ্বাস্য ভাবে পুজোর পৌরোহিত্য করিয়েছেন রাবণকে দিয়ে। দেখাতে চেয়েছেন, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে ব্রাহ্মণকে যুদ্ধে পরাজিত করা অসম্ভব, যদি না সেই ব্রাহ্মণ স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথ নেন। অাজ যাঁরা রাবণের মূর্তি পোড়ান তাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদী, না কি ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী?

হেম নাথ দাস

সোনারপুর

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

ভ্রম সংশোধন

‘মন্ত্রীকে বসিয়ে দিয়ে উত্তর দিলেন মমতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে (রাজ্য, পৃ ৬, ২৩-১১) কারিগরি মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর পদবি চট্টোপাধ্যায় লেখা হয়েছে এবং প্রশ্ন প্রসঙ্গে আইটিআই-এর বদলে আইআইটি লেখা হয়েছিল। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলগুলির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

History Mythology Ravana
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE