Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: ব্যাখ্যা এত সরল নয়

নিবন্ধে উল্লিখিত আর পাঁচ জন বাবা-মায়ের মতো তিনিও আসলে মনে করেন, শুধুমাত্র শিক্ষকের সদিচ্ছার ওপরই শিক্ষার্থীর শিখতে পারা না-পারা নির্ভর করে।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

স্বাতী ভট্টাচার্য তাঁর ‘একটু সময় হবে স্যর’ (১৭-১১) নিবন্ধে একটু নতুন স্টাইলে হলেও শিক্ষাসমস্যা সংক্রান্ত বিশ্লেষণের ফ্যাশনটি বজায় রাখতে পেরেছেন। অর্থাৎ, যে কোনও প্রকারে শুধুমাত্র শিক্ষকদের দিকে আঙুল তোলা। কারণ, নিবন্ধে উল্লিখিত আর পাঁচ জন বাবা-মায়ের মতো তিনিও আসলে মনে করেন, শুধুমাত্র শিক্ষকের সদিচ্ছার ওপরই শিক্ষার্থীর শিখতে পারা না-পারা নির্ভর করে। তিনিও মনে করেন, জীবন্ত মানবশিশু খেতের ধান বা কারখানার মালের মতো অনুভূতিহীন বস্তুপিণ্ড। তাই হাতে কাস্তে নিয়ে সময় দিলেই যেমন ধান কাটা হয়ে যায়, বা কারখানায় মেশিনে লেবার দিলেই যেমন ‘ফিনিশ্ড’ মাল তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসে, তেমনই শিক্ষক খাটলেই শিক্ষার্থী শিখে ফেলতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শিক্ষাবিজ্ঞান এই সরল ব্যাখ্যা মানতে রাজি নয়। তা বলে: শিক্ষা একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। শিক্ষকের পাঠদান এবং শিক্ষার্থীর শেখার সামর্থ্য— এই দুইয়ের সঠিক মেলবন্ধনের মাধ্যমেই একমাত্র শিক্ষার্থী শিখতে পারে। শিক্ষার্থীর শেখার সামর্থ্য নির্ভর করে মূলত তার আর্থ-সামাজিক পরিবেশ এবং সেই পরিবেশের প্রভাবে প্রভাবিত তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান এবং তাকে ভিত্তি করে তার মনঃসংযোগ, পাঠে অংশগ্রহণ, পঠিত বিষয়ের অনুশীলন প্রভৃতি আপাত-সরল কিন্তু বাস্তবে সময়সাধ্য এবং কতকগুলো জটিল প্রক্রিয়ার ওপর। এই কারণেই দেখা যায়, শিক্ষক মাত্র তিন-চার জন শিক্ষার্থীকে একই সময়ে একটা বিষয় পড়ালেও, এক-এক জন শিক্ষার্থীর পাঠটি গ্রহণ করতে পারার মান বিভিন্ন রকম হয়। মির্জাপুরের মামণি বর্মণ প্রাইভেট টিউটর বা স্কুলের শিক্ষক— যাঁর বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনুন না কেন, তার কোনও মতেই সাধারণীকরণ চলে না। বর্তমানে শহরাঞ্চলে তো বটেই, এমনকী শহরের কাছের অনেক গ্রামেও বিত্তবান ঘরের ছেলেমেয়েরা সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলেই পড়ে না। তারা পড়ে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। সরকারি স্কুলের সিংহভাগ ছাত্রছাত্রীই নিম্নবিত্ত ঘরের। কাজেই তাদের বঞ্চিত করে বিত্তবান ঘরের সন্তানরা শিক্ষকের সময় খেয়ে নিচ্ছে— এটা আজগুবি সিদ্ধান্ত।

সর্বোপরি, মনে রাখা দরকার, বিত্তবান কি বিত্তহীন— যে কোনও শিশুর পড়াশোনার জন্য দরকার সুস্থ সামাজিক এবং পারিবারিক পরিবেশ। উভয় শ্রেণিরই পরিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে মদ, পর্নোগ্রাফি এবং উচ্ছৃঙ্খল, যা খুশি করতে চাওয়া জীবনবোধের ব্যাপক প্রসার। বাবা মা, আত্মীয়, প্রতিবেশীদের এই কদর্য জীবনবোধ, বছরের মধ্যে চার মাস ধরে পুজো, দু’মাস ধরে ভোটভিত্তিক খুনোখুনি, বিয়ে জন্মদিন বিজয়া দোল সব কিছু নিয়েই উদ্দাম হুল্লোড়, নাচানাচি— এ সব কিছুই শিশুমনকে জন্ম থেকেই অস্থির বিকৃত ভাবে গড়ে তুলছে। ফলে তারা মনঃসংযোগই করতে পারছে না। দু’কথা পড়া, বলা, বা লেখার ধৈর্যটুকুই তাদের গড়ে উঠছে না। এর সঙ্গে দরিদ্র পরিবারে রয়েছে অশান্তি, ক্ষুধা, অল্প বয়সে কাজে ঢুকে পড়া, বিয়ে, এমনকী পরিবারে ভাঙন। এত কিছু মারাত্মক সমস্যায় আক্রান্ত, তার ওপর পুষ্টিহীন, খেলাধুলো-ব্যায়ামের সু্যোগহীন শিশুদের শুধু আরও বেশি ক্ষণ পড়ালেই তারা পড়া গ্রহণ করতে পারবে— এ এক হাস্যকর কষ্টকল্পনা মাত্র।

পার্থ ভট্টাচার্য

উত্তর ২৪ পরগনা

শেখার চেষ্টা কই


শিক্ষা নিয়ে দু’রকমের লেখা চোখে পড়ে। এক রকম লেখার ভিত্তি হল শুধুই পরিসংখ্যান। অঙ্কের হিসেবে বুঝে নেওয়া, পড়াশোনার কোথায় ফাঁক হচ্ছে। আর অন্য ধরনের যে লেখার মূলে শুধুই সহমর্মিতা আর সহানুভুতি। আহা, বাচ্চাগুলো কিছুই শিখছে না। অথচ কত সম্ভাবনা। ‘একটু সময় হবে, স্যর’ দ্বিতীয় ধারার লেখা।
ক্লাসে যারা ভাল, মাস্টাররা তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। যারা পারে না, তাদের অবহেলা করা হয়। ঠিক কথা। তা হলে মাস্টারমশাই কী করবেন? যারা পারে না তাদের দিকে নজর দেবেন। দিলেন। এতে কী হবে? যারা পারে, তারা আগ্রহ হারিয়ে বসে থাকবে। ক্রমশ তারাও ওই না-পারাদের দলে যত ক্ষণ না আসছে, যেন বৃত্তটা সম্পূর্ণ হচ্ছে না। এ ভাবে যারা পারছে না, আর যারা পারছে, তারা দু’জনেই কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না এই ব্যবস্থায়? শুধু সময় দিলে এর সমাধান করা যাবে কি?
শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ বাড়ছে। কিছু শেখাতে হলে শিক্ষার্থীকে আগ্রহী হতেই হবে। এর কোনও বিকল্প নেই। দারিদ্রের অজুহাতে সেই লড়াইকে দূরে ঠেলা যাবে না। যে কোনও বিষয়ে তাদের সবাইকে হাঁ করিয়ে শোনানো জাদুকরের পক্ষে দুঃসাধ্য। শিক্ষক তো তুচ্ছ।
কাজেই সমস্যা অনেক। শুধু পরিসংখ্যান তাকে ধরতে পারে না। শুধু সহানুভূতিও নয়। শিক্ষিত হতে হলে পরিশ্রম করেই হতে হবে। বিদ্যালয়ে নিয়মিত হাজির হতে হবে। কোনও কাজের দায়িত্ব পেলে তা পালনের চেষ্টা থাকা চাই। এ সব না থাকলে কিছু শেখা যাবে না। শিখতে চাইলে শেখানোর লোকের অভাব হয় না। শিক্ষার্থীর কাছেই সময় সবচেয়ে দামি। তাকে কে বঞ্চনা করবে, সে নিজে না চাইলে?


অরণ্যজিৎ সামন্ত
কলকাতা-৩৬

আসলে সিস্টেম


শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে যাঁরা গ্রহণ করেছেন, তাঁরা নিজের কাজটা আন্তরিক ভাবে করার পরিসর কতটা পান, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। সিলেবাস শেষ করার তাড়া আছে। অথচ পাশ-ফেল নেই। শাস্তিদানের ব্যবস্থা নেই। শৃঙ্খলারক্ষা করা তাই দুষ্কর। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাধিক্য বা মেধার তারতম্যজনিত কারণে ট্রেনিং থাকলেও পিছিয়ে-পড়াদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটা খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। আবার অন্য দিকে ‘ভাল ঘরের ছেলে’কেও সেই ভাবে দেখভাল করা যায় না। এই কারণেই ‘স্পেশ্যাল কেয়ার’ পেতে ইংলিশ মিডিয়ামমুখী তারা। স্কুলের বাইরে থেকে শেখা ভুলভাল ধারণা মুছে ফেলতে ‘আনলার্নিং’ পদ্ধতি প্রয়োগ করা শিক্ষকের কাছে খুবই চ্যালেঞ্জের। খুব বেশি প্রয়োগ করতে গেলে সামাজিক ভাবে শত্রু বৃদ্ধির সম্ভাবনাও থেকে যায়। আবার স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যেও কোনও একটি বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকার ভিন্নমত পোষণও শিক্ষার্থীর শিক্ষণকে ব্যাহত করে। বাইরে থেকে প্রাইভেট টিউটররা এতে অংশ নিলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠতে পারে। অনেক উচ্চশিক্ষিত অভিভাবক-অভিভাবিকাও স্কুলের শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষণ বিষয়ে মতান্তরের কারণে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এতে ধন্দে পড়ে শিক্ষার্থী!
তবে পরিস্থিতি যা-ই হোক, বাংলা মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় ব্যর্থতার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে শিক্ষকরাই ঘাতসহ এবং নতমুখ সেই মাধ্যম— যেটাকে খাড়া করে জনরোষের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া যায় সহজেই। এই সমাজ মনে করে, ‘‘শয়তান শুধু কামাচ্ছে। দিচ্ছে না কিছুই।’’ সমাজমাধ্যমে শিক্ষকতা পেশাকে নিরন্তর কাটাছেঁড়া করা হয়। তাই শিক্ষককেও আড়াল খুঁজতে হয়। উপেক্ষার, উদাসীনতার আড়াল। আমড়াগাছি বা মোসাহেবির আড়াল। প্রকৃত তথ্য গোপন করার কারসাজি রপ্ত করতে হয়। লেখিকা ঠিকই ধরেছেন: “এই হল ছক। উপরওয়ালার কাছে জবাবদিহি এড়াতে, টিউশন বাঁচাতে...”এই ছকের আসল নাম সিস্টেম। সিস্টেমের বাইরে যাওয়া শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়। যে ভাত দেয়, তার কথাই তো শুনতে হবে। সমাজ আবার শিক্ষককে উচ্চাসনে বসিয়েছে। মানুষ গড়ার কারিগর। পরিস্থিতিতে যখন সেই শিক্ষকের কাছে তার চাওয়া-পাওয়ার হিসেবটা মেলে না, তখনই সমাজের সমালোচনার সহজ শিকার শিক্ষক। তাই শিক্ষকদের সম্মানও নেই। সামাজিক সুরক্ষাও নেই।


পার্থ প্রতিম চৌধুরী
কোন্নগর, হুগলি

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও

ভ্রম সংশোধন

‘পথে না বেরোনোই একমাত্র পথ সদ্য মায়েদের?’ শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদনে (কলকাতা, পৃ ১৪, ৩০-১১) অভিনেত্রী-উপস্থাপিকা সুদীপা চট্টোপাধ্যায়ের পদবি লেখা হয়েছে বন্দ্যোপাধ্যায়। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Academics Children
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE