Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: তাঁর বৈশিষ্ট্য

উনি কাউকে ‘তুমি’ বলতেন না, হাঁটুর বয়সি লেখককেও ‘আপনি’ বলতেন।

রমাপদ চৌধুরী।

রমাপদ চৌধুরী।

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

লেখালিখির সূত্রে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে নিয়মিত যেতাম। সাহিত্যিক ও সম্পাদক রমাপদ চৌধুরীর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য নজরে পড়েছে।

ক) রমাপদবাবু কাজের বাইরে একটি অতিরিক্ত কথাও পছন্দ করতেন না, তাঁর দফতরে লেখা নিয়ে গেলে প্রথম যে প্রশ্নটা ধেয়ে আসত তা হল, ‘‘কী চাই?’’, উত্তরে কেউ যদি বলতেন লেখা জমা দিতে এসেছেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন, ‘‘কী লেখা?’’ অর্থাৎ ছোটগল্প না প্রবন্ধ। উত্তর পেলে পরের প্রশ্ন, ‘‘ঠিকানা দিয়েছেন?’’ তাঁর সম্মতিসূচক উত্তর পেলে লেখাটি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিতেন, বুঝিয়ে দিতেন, কাজ হয়েছে, এ বার আপনি আসতে পারেন। তার পরেও যদি কেউ দাঁড়িয়ে থাকতেন বা তাঁকে খুশি করতে বাক্যব্যয় করতেন তা হলে তাঁর কপালে দুঃখ অবধারিত, তবে সে দুঃখ লেখার কপাল পর্যন্ত গড়াত না, কারণ লেখাটি ভাল হলে দ্রুতই ছাপা হত।

খ) উনি কাউকে ‘তুমি’ বলতেন না, হাঁটুর বয়সি লেখককেও ‘আপনি’ বলতেন।

গ) কাউকে এক বার দেখলে ভুলতেন না। আসা-যাওয়ার পথে বা সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় তাঁকে দূরে দেখে কেউ পালানোর চেষ্টা করলেও লাভ হত না, রমাপদবাবুকে দেখার অনেক আগেই রমাপদবাবুই তাঁকে দেখে ফেলতেন।

ঘ) কোনও লেখকের প্রশংসা বা সুপারিশ রমাপদবাবু গ্রাহ্য করতেন না, কারণ লেখকরা পাঠকদের মতো নির্মোহ হয়ে লেখার বিচার করতে পারেন না, তাঁর এই বিশ্বাস ছিল পাকা।

ঙ) কোনও লেখকের লেখা পছন্দ করলেও রমাপদবাবু সরাসরি তাঁর প্রশংসা করেছেন এমন কমই হয়েছে, তাই তার দায়িত্ব নিতেন অফিসের লোকেরা, তাঁরা লেখককে তা জানিয়ে বাধিত করতেন।

শুভমানস ঘোষ

ভদ্রকালী, হুগলি

বাঙালি ও অসম

‘অসমে ৪০ লক্ষ তালিকার বাইরে’ (৩১-৭) পড়ে এই চিঠি। প্রথমেই দু’টি তথ্য দিই। ৩০ জুলাই প্রকাশিত অসমের নাগরিক পঞ্জিতে নাম নেই অসম বিধানসভারই ডেপুটি স্পিকার দিলীপ কুমার পালের স্ত্রী অর্চনা পালের। বাদ গিয়েছে মরিগাঁও-এর বিজেপি বিধায়ক রমাকান্ত দেউড়ির নামও। যে সব হিন্দু বাঙালি (ঘটি এবং বাঙাল) এখনও ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’-এর নেশায় বুঁদ হয়ে কপালে গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দলের মিছিলে গলা ফাটাচ্ছেন, এই তথ্য দু’টি তাঁদের জন্য একটি শিক্ষা। ধর্মান্ধ, জাতিবিদ্বেষী সঙ্ঘ পরিবার চরিত্রগত ভাবে বিদ্বেষী, এক বছর আগে ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ পত্রিকার এক সাংবাদিক ‘স্বয়ংসেবক’ সেজে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ডেরায় ঢুকে সঙ্ঘের বাঙালি-বিদ্বেষী চরিত্র উন্মোচন করেছিলেন। বিশিষ্ট গায়ক প্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্রী পরমা ভট্টাচার্যের নামও বাদ গিয়েছে নাগরিক পঞ্জি থেকে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। বিশিষ্ট গায়ক সুমিতা ভট্টাচার্য, পদার্থবিদ্যার শিক্ষিকা শান্তা ভট্টাচার্য ঠাঁই পাননি নাগরিক পঞ্জিতে। এ যেন ১৯৭১-এ খানসেনা আর রাজাকারদের বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধনের এক সামাজিক রূপ। বাঙালি, হিন্দু হোক বা মুসলিম, হাজার দেশভক্তি দেখিয়েও ধর্মান্ধ সঙ্ঘ পরিবারের কাছে ‘ভারতীয়’ বা ‘স্বদেশি’ হতে পারবে না। যেমন ৩০ বছর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করেও নিজের নামটি নাগরিক পঞ্জিতে দেখতে পাচ্ছেন না অসমবাসী মহম্মদ আজমল হক। তবে এটা ভাবারও কারণ নেই যে শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষিত বিশিষ্ট জনেরাই বাদ পড়েছেন। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়া বেশির ভাগ বাঙালি শ্রমজীবী শ্রেণির।

একটা কথা মনে রাখা দরকার। অসম কোনও ভাষাভিত্তিক বা জাতিভিত্তিক রাজ্য নয়, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক ভাবে। ১৮৭৪ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে কাছাড়, সিলেট ও গোয়ালপাড়া জেলাকে বিচ্ছিন্ন করে অসমের সঙ্গে জুড়ে দেয় শাসক ইংরেজরা, ফলে ওখানকার বাঙালিরা ১০০ শতাংশ ভূমিপুত্র। ১৯১১-য় বঙ্গভঙ্গ বাতিলের আনন্দে বাংলার রাজনৈতিক নেতারা সেই নির্বাসিত ভূখণ্ডের বাঙালির কথা বেমালুম ভুলে গেলেন! তপোধীর ভট্টাচার্যের লেখা থেকে জানতে পারি, প্রাচীন যুগেও কাছাড়ের পূর্বপ্রান্তে ভুবন পাহাড়ে বাংলার পাল-সেন যুগের সমকালের বাঙালি শিল্পীদের তৈরি ভাস্কর্যের নিদর্শন মেলে। তারও তিন-চারশো বছর আগে পূর্ব সিলেটে প্রাপ্ত নিধনপুর তাম্রশাসন তদানীন্তন করিমগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় কোনও না কোনও বাঙালি জনপদের ঐতিহাসিক অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়। মধ্যযুগের ভারতীয় সংস্কৃত পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্রে বরাক উপত্যকায় বাঙালি জনপদগুলির ইশারা পাওয়া যায়। সুতরাং, বাঙালি মাত্রই বাংলাদেশি, অসম শুধু অসমিয়াদের, অসম-শাসক শ্রেণি ও সঙ্ঘ পরিবারের এই নীতি, স্বৈরশাসক হিটলার-গোয়েবলসের ইহুদি ও কমিউনিস্ট নিধনকে মান্যতা দেওয়ার ঘৃণ্য প্রচারের সমগোত্রীয়।

চল্লিশ বছরের লাগাতার প্রচেষ্টায় অসমিয়া ভাষিক আধিপত্যবাদীরা সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার, আমলাতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থার একাংশ-সহ তথাকথিত সর্বভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণা বদ্ধমূল করে দেয় যে, গোটা অসম আজ বাংলাদেশিদের দখলে। এবং বাংলার বাইরে বসবাসকারী সমস্ত বাঙালিই বাংলাদেশি! এই জন্যই কয়েক বছর আগে রাজধানীর কাছে একটি শ্রমজীবী বাঙালি বস্তি মিথ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর এক উচ্চবিত্ত শ্রেণির অবাঙালি মহিলা টিভিতে সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘ওরা সবাই বাংলাদেশি’’, অথচ বস্তিবাসী প্রত্যেকেই ছিলেন বৈধ ভারতীয়! লাভ-জেহাদের মিথ্যে অভিযোগে যখন বাঙালি আফরাজ়ুল খানকে পুড়িয়ে মারছিল ধর্মান্ধ, জাতিবিদ্বেষী শম্ভুলাল রেগা, তখন তার মাথায় খুনের কারণ হিসেবে কাজ করছিল আফরাজ়ুলের মুসলিম পরিচয়ের সঙ্গে তাঁর বাঙালি পরিচয়টিও। এখন, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়া ৪০,০৭,৭০৭ জনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বাঙালিরা বুঝেছেন, সঙ্ঘ-শাসিত হিন্দুস্থানে বাঙালি হয়ে জন্মানো এক অপরাধ। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতারা আজ যতই প্রতিবাদী হওয়ার ভড়ং দেখান, ১৯৮৫ সালে রাজীব গাঁধীর নেতৃত্বে কেন্দ্র ও বাঙালি-বিদ্বেষী অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত অসম চুক্তি আসলে বাঙালিদের সর্বনাশ করার সনদে স্বাক্ষর দিয়েছিল। তারও আগে ইন্দিরা-জমানায় ঘটে যাওয়া নারকীয় নেলি হত্যাকাণ্ডের দায় কার? অনেকটাই কংগ্রেসের অপশাসন নয় কি? আজকের নাগরিক পঞ্জি যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা তরুণ গগৈ-এর মস্তিষ্কপ্রসূত তা তিনি নিজেই দাবি করেছেন। ইতিহাস সাক্ষী আছে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের’ রাজনীতি করেছে কংগ্রেসও। দেশভাগের সময় গণভোটের ফলে করিমগঞ্জ বাদ দিয়ে বাকি সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তখন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেল অসমে এসে বলেছিলেন ‘‘সিলেট ভারতের ক্যানসার। তা বাদ দেওয়ায় অসম রোগমুক্ত হল।’’ পটেলের নব্য অনুগামীরাই তো আজ ক্ষমতায়, তারা সেই ‘রোগমুক্তি’র কাজ দ্রুত চালিয়ে যাচ্ছে!

অসম সরকার বলছে, বাদ পড়া মানুষদের ডিটেনশন শিবিরে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। অথচ অসম রাজ্যে ৬টি ডিটেনশন শিবির আছে, বন্দি প্রায় ৯০০। গোয়ালপাড়ায় ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫০০ জন থাকার মতো ডিটেনশন শিবির তৈরি হচ্ছে।

তাই আজ প্রতিবাদে নামতে হবে, ঠিক যেমন ১৯৬১-র ১৯ মে শিলচর স্টেশনে বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন বরাক উপত্যকার ১১টি সাহসী প্রাণ। আজ বরাকের বাঙালিকে তৎপর হতে হবে নাগরিকত্ব বাঁচাতে। এখানকার প্রায় ৪ লক্ষ নাগরিক বাদ পড়েছেন এনআরসি থেকে, যার সিংহভাগ বাঙালি। উদ্যোগী হতে হবে বাংলা, ত্রিপুরা-সহ সমস্ত রাজ্যের অধিবাসী বাঙালিদেরও। নইলে, এক দিন হয়তো তাঁরা ঘুম থেকে উঠে দেখবেন, তাঁরা হঠাৎ ‘বাংলাদেশি’ অথবা ‘বিপজ্জনক ভোটার’ বলে ঘোষিত হয়েছেন!

রুদ্র সেন

কলকাতা-২৮

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE