Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: জ্যোতি বসু দায়ী নন

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সরকার ১৯৭৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যসূচিকে আরও বাস্তবানুগ ও জীবনমুখী করার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করে।

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৮ ০০:৩৯
Share: Save:

‘বাংলা মিডিয়াম’ (১৫-৩) পত্রটিতে কিছু ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। প্রামাণ্য সূত্রের ভিত্তিতে ঠিক চিত্রটি তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারত সরকার শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনার জন্য কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি-কমিশন গঠন করেছিল। তাদের সব ক’টি প্রতিবেদনেই প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি শেখানোর বিরুদ্ধে সুপারিশ করা হয়েছে। নিম্ন শ্রেণি থেকে ইংরেজি পাঠ সুফলদায়ী তো নয়ই, বরং তা যে ক্ষতিকর হতে পারে সে-দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বহুচর্চিত কোঠারি কমিশন বলেছে: '...the effective teaching of English in the lower primary classes where millions of pupils are enrolled, requires a very large number of trained teachers who are not available. ... In our opinion, this is a colossal task, the improper pursuit of which will lower rather than upgrade the standards of English at the school stage.'

এই সব কমিটি-কমিশনের সুপারিশসমূহ বিবেচনা করে ভারতীয় সংসদে প্রথম শিক্ষানীতি গৃহীত হয় ১৯৬৮ সালে। এখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শুধু মাতৃভাষা শেখাবার বিধান দেওয়া হয়েছে। এই নীতি অনুসরণ করে ভারতের প্রায় সব রাজ্য ১৯৭৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় দ্বিতীয় ভাষা বর্জন করেছিল।

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সরকার ১৯৭৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যসূচিকে আরও বাস্তবানুগ ও জীবনমুখী করার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করে। চেয়ারম্যান হন বিশ্বভারতীর বিনয় ভবনের অধ্যক্ষ পণ্ডিত ড. হিমাংশু বিমল মজুমদার। (সরকারি আদেশনামা নং ১৪৩৫- ই ডি এন (পি), তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)। কিন্তু গঠিত হওয়ার পরে দীর্ঘ দিন এই কমিটি কোনও কাজ করেনি। বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বে এসে এই কমিটিতে দলমত নির্বিশেষে সব ক’টি অনুমোদিত প্রাথমিক শিক্ষক সংস্থার প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে কমিটিকে সম্প্রসারিত ও সক্রিয় করল। সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনমত আহ্বান করা হল।

এই পর এই কমিটি হিমাংশুবাবুর যোগ্য নেতৃত্বে বিষয়টির সব দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও মত বিনিময়ের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালের ২৩ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষার নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করে। সেখানেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শুধু মাতৃভাষা শেখাবার সুপারিশ ছিল। বামফ্রন্ট সরকার সমগ্র প্রতিবেদনটি গ্রহণ করে ১৯৮১ শিক্ষাবর্ষ থেকে তা চালু করে। উল্লিখিত পত্রটিতে বলা হয়েছে, ‘জ্যোতি বসু... নিদান দিলেন, প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি তুলে দাও। প্রথম কমিউনিস্ট সরকার এসেই একটি কমিশন গঠন করলেন এ-রাজ্যে ইংরেজি শিক্ষার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে।’ এ কথাগুলির ভিত্তি কী, বোঝা গেল না।

ঋতম্ মুখোপাধ্যায় সিটি সেন্টার, দুর্গাপুর

এ রাজ্যে ইংরেজি

‘কেন বিধি হল বাম’ এবং ‘বাংলা মিডিয়াম’ (১৫-৩) শীর্ষক দুটি চিঠিতেই সরকারি স্কুল থেকে ইংরেজি বিতাড়নের জন্য তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। এই তথ্যগত ভুলটি অনেকে করলেও, প্রকৃত চিত্রটা তুলে ধরা অত্যন্ত প্রয়োজন। সবিনয় বলি, স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়ে পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েরা ক্লাস টু থেকে ইংরেজি শিখত। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী হরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে 'Reorganisation of School Education' নামে কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সুপারিশক্রমে ১৯৫০ সাল থেকে, প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হয়। অভিভাবকদের বিপুল চাপের ফলে ১৯৬৪-তে প্রাথমিকে ইংরেজি আবার ফিরে আসে এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে তা চালু হয়।

১৯৮৪ সালে ফের প্রাথমিক থেকে ইংরেজি বিদায় নেয় এবং ‘স্ট্রাকচারাল সিলেবাস’-এর বদলে ‘ফাংশনাল সিলেবাস’ চালু হয়। বলা হয় "It will always be advisable to help the learners to learn to 'use' the language first and then present the grammar where necessary." সেটা জ্যোতি বসু ‘প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি তুলে দাও’ জাতীয় ‘নিদান’ হাঁকার জন্য হয়নি, হয়েছিল কিছু যুক্তিগ্রাহ্য কারণে।

এ প্রসঙ্গে মুদালিয়ার কমিশন (১৯৫২-৫৩) বলেছিল "...English should be a compulsory subject of study in the Secondary school beginning from the middle school stage.'' ১৯৫৩ সালে দিল্লিতে ইংরেজির অধ্যাপকদের সম্মেলনে মাধ্যমিক স্তরে ছ’বছরের সময়সীমায় ইংরেজি শেখানোর কথা বলা হয়েছিল। সঙ্গে বলা হয়েছিল "...with improvement in the training of teachers of English it should be possible to curtail the duration of the course by one year, provided, however, that English is taught for six periods of fifty minutes each per week." ১৯৫৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত রাজ্য শিক্ষামন্ত্রী সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়— "...the teaching of English should be compulsory at the secondary stage as well as the middle, senior basic or the lower secondary stage."

বিদ্যালয় স্তরে ঠিক কখন থেকে ইংরেজি শেখা উচিত সে ব্যাপারে স্পষ্ট মত দিয়েছিল কোঠারি কমিশন (১৯৬৪)। কমিশনের মতে "At the primary stage, language learning can be a big burden on a child if it is imposed; and such imposition can vitiate his entire attitude towards his studies and may generate hostility to the school itself. This would indeed be a tragedy at a time when our chief objective is to win the masses over to education." সেই কারণেই তাঁরা বলেন— "The teaching of English should ordinarily not begin earlier than class V after adequate command has been acquired over the mother tongue. The introduction of the study of English earlier than class V is educationally unsound."

দু’দুটি শিক্ষা কমিশন, ইংরেজির অধ্যাপকদের সম্মেলন, রাজ্য শিক্ষামন্ত্রী সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের সঙ্গে যোগ হয় ১৯৭৫ সালে গঠিত অধ্যাপক হিমাংশু বিমল মজুমদার কমিটির সুপারিশ, যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণির আগে দুটি ভাষাশিক্ষাকে 'tortuous and unscientific' বলা হয়েছিল।

এই দীর্ঘ ইতিহাস থেকে জানা যায়, কংগ্রেস আমলে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি বিদায় নিয়েছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৬৩— অর্থাৎ ১৪ বছর। আর বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি বিদায় নিয়েছিল ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮— অর্থাৎ ১৫ বছর। অথচ ১৯৬৪ সাল থেকে পরবর্তী ১৯ বছর ইংরেজি ক্লাস থ্রি থেকে পড়তে হলেও, ১৯৯৯ সালে প্রথমে ক্লাস টু থেকে এবং পরবর্তীতে ২০০৪ থেকে প্রথম শ্রেণি থেকেই ইংরেজি পড়ানো চালু হয়ে যায়। ১৯৫০ থেকে ১৯৮৩ অবধি ৩৪ বছর প্রাথমিকে ইংরেজি না পড়ে, বা ক্লাস থ্রি থেকে পড়ে, এ রাজ্যের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে মহাপণ্ডিত হয়েছেন; অথচ ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ অবধি ২১ বছরে প্রাথমিকে ইংরেজি না পড়ে, বা ক্লাস টু থেকে বা ক্লাস ওয়ান থেকে পড়ে, এ রাজ্যের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে মহামূর্খ হয়েছেন!

আসলে প্রথম দিকে ছেলেমেয়েরা ট্রানস্লেশন করে আর প্যারাগ্রাফ-লেটার মুখস্থ করে উতরে গিয়েছেন, এখন দু’চারটে গাইডেড কম্পোজিশন শিখতে পারলেই মুঠো-মুঠো নম্বর পাচ্ছেন। ইংরেজি শেখা কিন্তু যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গিয়েছে।

দেবোত্তম চক্রবর্তী দণ্ডপাণিতলা, নবদ্বীপ

ভ্রম সংশোধন

এই পত্রিকার কিছু সংস্করণে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুরের আমলাশোল (২৬-৩, পৃ ৫)। সেটি হবে আমশোল। অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবিতে লেখা হয়েছে, ‘বিখ্যাত বাঘিনি বিজলির নাতনি মছলি’ (পৃ ৭)। সেটি হবে ‘মছলির নাতনি বিজলি।’ অনিচ্ছাকৃত এই ভুলগুলির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jyoti Basu English Education Responsibility
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE