Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: নেতাজি রহস্য

‘এ বার ফিরিয়ে আনা হোক চিতাভস্ম’ শীর্ষক দেবব্রত ঠাকুরের নিবন্ধ (রবিবাসরীয়, ২৮-১০) এই কথা প্রতিপন্ন করার নিপুণ চেষ্টা করেছে যে, ১৯৪৫ সালের ১৮ অক্টোবর বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয় এবং রেনকোজি মন্দিরে রক্ষিত চিতাভস্ম নেতাজির।

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৫৯
Share: Save:

‘এ বার ফিরিয়ে আনা হোক চিতাভস্ম’ শীর্ষক দেবব্রত ঠাকুরের নিবন্ধ (রবিবাসরীয়, ২৮-১০) এই কথা প্রতিপন্ন করার নিপুণ চেষ্টা করেছে যে, ১৯৪৫ সালের ১৮ অক্টোবর বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয় এবং রেনকোজি মন্দিরে রক্ষিত চিতাভস্ম নেতাজির। নিবন্ধে উল্লেখিত ব্যক্তিদের বয়ানের অসঙ্গতি নিবন্ধকারের নজরে এল না, এক বারের জন্য মনে কোনও প্রশ্ন এল না; তথ্য বা বয়ানগুলি বিশ্লেষণের ধার দিয়েও তিনি গেলেন না, মুখার্জি কমিশনের সিদ্ধান্তের পরেও। কেবলমাত্র শাহনওয়াজ কমিটির রিপোর্টের (যা সর্বসম্মত নয়— সুরেশচন্দ্র বসুর ভিন্ন রিপোর্ট ছিল) উপর তাঁর অসীম আস্থা অনুভব করা যায়, যদিও এ ব্যাপারে এর পরেও দু’দুটি কমিশন গঠিত হয়েছে।

বিস্ময়ের এই যে, সমকালীন বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক রাষ্ট্রপ্রধানের বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল দাবি করা হচ্ছে কোনও প্রামাণ্য বিশ্বাসযোগ্য নথিপত্র ব্যতিরেকেই, কেবলমাত্র কিছু ব্যক্তির মৌখিক বয়ানের ভিত্তিতে। এমন এক অগ্রগণ্য বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব, যাঁকে মিত্রশক্তি ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলে গণ্য করত, তাঁর ‘মৃত্যু’র নেই কোনও ডেথ সার্টিফিকেট (৪৩ বছর পরে ডা. য়োশিমির ইস্যু করা সার্টিফিকেট ব্যতীত) কিংবা ক্রিমেশন সার্টিফিকেট; নাম নেই ক্রিমেশন রেজিস্ট্রারে। সর্বোপরি, ১৮ অগস্ট ১৯৪৫-এ বা ওই সপ্তাহে তাইহোকু বিমানঘাঁটিতে কোনও বিমান দুর্ঘটনা হয়নি— তাইপে সরকার এমন তথ্য সরকারি ভাবে জানিয়েছেন এবং সমসাময়িক স্থানীয় কোনও সংবাদপত্রেও এমন বিমান দুর্ঘটনার সংবাদ অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি। তবু বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা প্রচার করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য ‘বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি মৃত্যু’র তত্ত্ব প্রমাণে মুখার্জি কমিশনের সামনে সাত জন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তাঁদের সাক্ষ্য, এবং পূর্ববর্তী কমিটি ও কমিশনের কাছে দেওয়া সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণাদি বিবেচনা বিশ্লেষণ করে মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টে এ কথা পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছে যে তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি এবং জাপানে রেনকোজি মন্দিরে রাখা চিতাভস্ম নেতাজির নয়।

কিন্তু প্রথম ইউপিএ সরকার উপযুক্ত কারণ ছাড়াই রিপোর্ট বাতিল করেছে বিশেষ উদ্দেশ্যে। নিবন্ধে বলা হয়েছে, বিভিন্ন মহলের চাপে ডিএনএ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত কমিশন নিতে পারেনি। কিন্তু কোন ‘মহল’-এর চাপ? তখন তো ‘নেতাজির মতো টুপি মাথায় দিয়ে লালকেল্লায় বক্তৃতা’ প্রদানকারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। কমিশনের রিপোর্টের মনোযোগী পাঠে উপলব্ধ হয়, কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ের এক আদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সর্বসম্মত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে গঠিত এই কমিশনের কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে শৈথিল্য ছিলই, এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনে সরকারি তরফে সহযোগিতার আরও অভাব হওয়া স্বাভাবিক।

নিবন্ধে আশিস রায়ের লেখা সাম্প্রতিক একটি বইকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে আরও দু’টি উল্লেখযোগ্য সাম্প্রতিক বই— অনুজ ধরের ব্যাক ফ্রম ডেড: ইনসাইড দ্য সুভাষ বোস মিস্ট্রি এবং হোয়াট হ্যাপেনড টু নেতাজি বিবেচনায় আসেনি।

উল্লেখ্য, ইতিহাসবিদ প্রতুল গুপ্ত আ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান আর্মি ১৯৪২-৪৫ শীর্ষক বই লেখার দায়িত্ব পেয়ে যে পাণ্ডুলিপি সরকারের কাছে জমা দেন ১৯৫০ সালে, তা আজ পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি।

হ্যাঁ, কেবলমাত্র লালকেল্লায় ভাষণ দিলে হবে না (যদিও হয়তো এই প্রথম নেতাজি এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ একটু সরকারি স্বীকৃতি লাভ করল)। এই রহস্য উদ্ঘাটনের সদুদ্দেশ্যে অবিলম্বে প্রতিশ্রুতি মতো বাকি ৪১টি ফাইল প্রকাশ করা প্রয়োজন, এবং সংশ্লিষ্ট বিদেশি রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন এ সংক্রান্ত তাদের ফাইলগুলি প্রকাশের জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে বলা হয় যে, নেতাজি সংক্রান্ত এমন কিছু গোপন ফাইল আছে যেগুলি প্রকাশ করলে কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। রহস্য এখানেই। কী সেই ঘটনা, যা বিশ্ববাসী জ্ঞাত হলে ওই বিদেশি রাষ্ট্র/রাষ্ট্রগুলি রোষান্বিত হতে পারে। স্বাধীনতার এত দিন পরেও কেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকার বিদেশি রাষ্ট্রের রোষানলের ভয়ে দেশের এক শ্রেষ্ঠ সন্তানের পরিণতি গোপন করার উদ্দেশ্যে নিপুণ ভাবে নিস্পৃহ থেকে যাবে? প্রসঙ্গত, অন্তর্ধান/ মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের পূর্বেই রেনকোজির ‘চিতাভস্ম’ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব কি রহস্য সমাধানের দাবি হিমঘরে পাঠানোর পরিকল্পনার অঙ্গ?

নিবন্ধে সুব্বিয়ার আপ্পাদুরাই আইয়ারের বই থেকে একটি উদ্ধৃতি আছে। ওই বইয়েরই অন্যত্র দেখা যাবে, আইয়ার নিজেই ‘বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু’র সংবাদ শুনে বিশ্বাস করতে পারেননি এবং সরজমিনে দেখতে ঘটনাস্থলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে সুযোগ দেওয়া হয়নি।

শান্তনু রায়

কলকাতা-৪৭

প্রশ্নমালা

১) বিমান দুর্ঘটনা— কিন্তু বিমানে নেতাজির পাশে বসা হবিবুর রহমান প্রায় সম্পূর্ণ অক্ষত। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ বইটিতে জেনেছি প্রথমে জাপানি অফিসাররা ওই প্লেনে নেতাজি ছাড়া আর কাউকে নিতে রাজি হননি। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের কম্যান্ডাররা কোনও মতেই নেতাজিকে একা ছাড়তে চাননি। তখন নেতাজি নিজেই হবিবুর রহমানকে বেছে নেন!

২) যদি বিমান তাইহোকু বিমানবন্দরের বিশ-ত্রিশ মিটার উঠেই তা ভেঙে পড়ত, তা হলে আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্য কম্যান্ডাররা তা দেখতে পেতেন। কারণ ওঁরা সে সময়ে ওখানেই ছিলেন। তাই এত দিন শুনতাম, তাইহোকু বিমান থেকে প্লেনটি কিছু ক্ষণ ওড়ার পর তা ভেঙে পড়ে।

৩) বিশ্বযুদ্ধের অবসানে নেতাজির মতো এত বড় মাপের মানুষের ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া যায় না, সেটা দেওয়া হয় অখ্যাত এক জাপানি সেনার নামে, শুধুমাত্র ইংরেজদের চোখকে ফাঁকি দিতে?

৪) নেতাজির মৃতদেহের ছবি কেউ কখনও দেখিনি। কেন? লেখকের বয়ান, দেহটি যে কফিনে ভারতে আসবে, সেটা বিমানে ঢুকছিল না। জাপানে এমন কোনও বিমান ছিল না, যাতে নেতাজির কফিন ঢুকতে পারে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন লক্ষ লক্ষ সেনার মৃতদেহের মধ্যে, সে যে দেশেরই হোক, পরিচয়হীনদের পুড়িয়ে ফেলা হত, পরিচয় জানলে, সুযোগ থাকলে মৃতদেহ তাঁর দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এমন কখনও ঘটেনি, বিমানে কফিন ঢোকেনি বলে মৃতদেহ পাঠানো যায়নি।

৫) একটা কফিনের ওপর বসে সবাই ছবি তুললেন, সেই কফিনটাই নেতাজি বনে গেল। এর পর সবাই মিলে সেই দেহটাকে পোড়ালেন, (ছবি নেই) এবং ভস্মটি বাক্সবন্দি করে পুজো করতে লাগলেন!

৬) হবিবুর রহমানের বয়ানটি যে নেতাজির আত্মগোপনের স্বার্থে রচিত, তা আজ জলের মতো পরিষ্কার। এই ঘটনাটি শরৎ বসু হবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেই বুঝতে পেরেছিলেন। এর কিছু কাল পরে পঞ্চাশের মাঝামাঝি থেকে শরৎ বসু নিজেই এ ব্যাপারে চুপ করে যান। এ নিয়ে আর কোনও কথাই তিনি বলেননি।

৭) নিবন্ধকারকে দোষ দিয়ে লাভ কী! আমরা সবাই পরিস্থিতির শিকার। জীবিত নেতাজির আত্মপ্রকাশ? এ দেশে তা কঠিন কাজ! যে স্বাধীন দেশের সরকার আজাদ হিন্দ ফৌজের একটি সেনাকেও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নেয় না, এমনকি, প্রথম দিকে তাঁদের পেনশনের দাবিও নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল, সে দেশের সরকারের কাছে ‘নেতাজি’ কতটা অপাঙ্‌ক্তেয় ছিলেন, সেটা বুঝতে দূরবিন লাগে না।

দয়া করে এ বার আপনারা নেতাজিকে রেহাই দিন। তিনি বেঁচে নেই। এর থেকে বড় সত্য আর কিছু হয় না। অহেতুক রাজনীতির ঘোলা জলে নেমে সন্দেহজনক ভাবে ওই ‘ছাই’ দেশে ফেরানোর নাম করে দেশকে আবার নতুন করে পুরনো নোংরা খেলায় মাতিয়ে লাভ কী?

তপজ্যোতি বসু

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Political leader Subhas Chandra Bose
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE