Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: সেই বন্যা ও মানুষ

সদর হাসপাতালে একটি রোগীও ওই বন্যায় ‍প্রাণ হারাননি। নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, ডাক্তার সকলে প্রত্যেকটি রোগীকে দোতলায় তুলেছিলেন, এমনকি সে দিন অপারেশন হয়েছে এমন রোগীকেও, তাঁদের বেড-সহ।

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৮ ০১:১৬
Share: Save:

প্রদীপ কুমার সেনগুপ্তের ‘একটি বন্যার পঞ্চাশ বছর’ (২-১১) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে কিছু কথা জানাই। সেই বন্যার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার। কলকাতায় পড়া ছাত্র, ছুটিতে গিয়েছিলাম বাবা-মা-বোনের কাছে পুজো কাটাতে। বাবা তখন জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসক— লালবাড়ি ডিএমও কোয়ার্টার্সের পাশেই বাবার কোয়ার্টার্স। মুষলধারা বৃষ্টিতে করলা নদীতে প্রতিমা ভাসানোর ‘বাইচ’ বন্ধ করে দিয়েছিল প্রশাসন। শুক্রবারের সেই রাতে শিলিগুড়ি রেডিয়ো বেতার নাটক থামিয়ে রাত ১০টা নাগাদ ঘোষণা করেছিল দোমোহনীতে বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা। সদর হাসপাতালে একটি রোগীও ওই বন্যায় ‍প্রাণ হারাননি। নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, ডাক্তার সকলে প্রত্যেকটি রোগীকে দোতলায় তুলেছিলেন, এমনকি সে দিন অপারেশন হয়েছে এমন রোগীকেও, তাঁদের বেড-সহ। আমাদের বাসস্থানের পাশেই জেল। রাতে যখন হুহু করে জল ঢুকছে শহরে, জেলের পাগলাঘণ্টি বেজে উঠেছিল, পরে শুনেছিলাম জেলার সব বন্দিকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ডাঙ্গুয়াঝাড় চা-বাগান— এ সবের বাসিন্দারা যে মানবিকতা দেখিয়েছিলেন, দিনবাজার, কদমতলার ব্যবসায়ীরা যে ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, তা এখনও ভুলিনি। রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ শহরের প্রত্যেককে খাইয়েছিল। ইউএনও থেকে সাহায্য পাওয়া গুঁড়ো দুধ এসেছিল পুজোর আগে। দুধের বস্তা খুলে শিশুদের খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন ডিসি। দুধ বিতরণ হয়েছিল ‘নার্সেস ট্রেনিং সেন্টার’ থেকে, সিস্টাররা নিজেরা কিচ্ছু না খেয়ে বাচ্চাদের দুধ খাওয়াচ্ছেন, নিজের চোখে দেখেছি। রাষ্ট্রপতির শাসনে রাজ্য তখন। রাজ্যপাল ধর্মবীর হাসপাতালের দোতলায় অফিস খুলে অন্তত ১০ দিন ছিলেন। আর সামরিক বাহিনী? তাঁরা যে কি করেছিলেন তার কোনও রেকর্ড আছে কি না জানি না, মৃত শহরে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

পবিত্র মুখোপাধ্যায়

কলকাতা-১০৭

একাই সরকার

‘একটি বন্যার পঞ্চাশ বছর’ পড়ে কিছু স্মৃতি মনে ভিড় করে এল। আমি তখন তিস্তার উল্টো পাড়ে কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমার শিক্ষানবিশ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ৪ অক্টোবর রাতে তিস্তা জলপাইগুড়ি শহরে প্রবেশ করেছিল, পরের দিন দুপুরে নদী বাঁধ ভেঙে আমাদের শহরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নামেই মহকুমা শহর তখন, জনসংখ্যা চার হাজারেরও কম। সরকারি ব্যবস্থাও প্রায় কিছুই ছিল না, পুরসভা বলতে মনোনীত সদস্যদের নিয়ে ‘টাউন কমিটি’। দিনটা লক্ষ্মীপুজোর ছুটির দিন ছিল, মহকুমাশাসক শহরে ছিলেন না, আমার কনিষ্ঠতর ডেপুটিও তখন ছুটিতে।

কয়েক দিন থেকে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছিল বলে আমি ট্রেজ়ারি অফিসার এবং ট্রেজ়ারি অ্যাকাউন্ট্যান্ট (অফিসের বড়বাবু) মলিনামোহন সরকার আলমারির নীচের তাক থেকে টাকা ওপরে তোলার হিসেবপত্র করছিলাম। ওখানে তখন ব্যাঙ্ক ছিল না বলে সরাসরি ট্রেজ়ারি থেকেই সরকারি টাকা আদানপ্রদান হত। হঠাৎ তিস্তা নদী শহরে প্রবেশ করল মানুষসমান জলপ্রবাহ নিয়ে। কয়েক জন সহকর্মী নৌকোয় চেপে এসে বললেন, ‘‘মলিনাদা, তোমার বাড়ি ভেঙে সবাই এবং সব কিছু ভেসে গিয়েছে বলে খবর এসেছে, চলো আমরা সেখানে যাচ্ছি।’’ হতভম্ব মলিনাবাবু সকলকে আরও অবাক করে বললেন ‘‘এতগুলো সরকারি টাকার ব্যবস্থা না করে যাই কী করে, কাজটা শেষ করে যাব।’’ ওঁরা প্রবল ভর্ৎসনা করে বেরিয়ে পড়লেন।

পরে অবশ্য খবর এল বাড়িঘর জিনিসপত্র সবই তিস্তা নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু বড়বাবুর স্ত্রীপুত্রকন্যাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অফিসের কাছেই আমার বাসস্থান, সদ্যবিবাহিতা খাস উত্তর কলকাতার কলেজপড়ুয়া বধূকে নৌকোয় তুলে মই বেয়ে পাশের বাড়ির ছাদে চালান করার পর আমি আর বড়বাবু নৌকোয় চললাম উদ্ধারকার্যে। কিছু দিন পরে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, ‘‘মেখলিগঞ্জ শহর যখন ডুবছে তরুণ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তখন নৌকাবিহারে ব্যস্ত ছিলেন তরুণী সঙ্গিনীকে নিয়ে।’’ সংবাদপত্রের পাতাটা ছদ্ম তিরস্কার-সহ আমাকে দিয়েছিলেন জেলাশাসক ভাস্কর ঘোষ।

পাহাড়ি নদী যেমন হঠাৎ আসে, দ্রুত প্রস্থানও করে। দক্ষিণবঙ্গের মতো জল জমে থাকার সমস্যা হয় না। পরের দিন সকালে বন্যার্ত জনগণ আমার বাড়িতে ভিড় জমালেন ত্রাণের দাবিতে— নদী তো সকলের সব কিছুই নিয়ে গিয়েছে। আমি শ্রীমান নিধিরাম সর্দার কাজ শুরু করলাম। ব্যবসায়ীদের গুদামে হানা দিয়ে যে কয়েক বস্তা ভিজে চালডালের সন্ধান পেলাম, নিজের সিদ্ধান্তে সরকারের তরফ থেকে ধারে কিনে নিলাম— ব্যাবসায়ীরা মহানন্দে সব বস্তা এনে জড়ো করলেন আমার বাড়ির সামনে। কিন্তু ‘সরকার’ বলতে তো আমি একা— সহকারী হিসেবে নিয়োগ করলাম আমার স্ত্রীকে। মাথাপিছু বরাদ্দ আমিই ঠিক করলাম এবং খাতা-কলম নিয়ে মাস্টার রোলের দায়িত্ব নিলাম। বেসরকারি কর্মী আমার স্ত্রী দুটো বাটি নিয়ে চালডাল বিলি শুরু করলেন। সন্ধের মধ্যে সব বস্তাই শেষ হয়ে গেল। পরের দিন থেকে অবশ্য ধীরে ধীরে আসল সরকার ময়দানে নামল এবং কয়েক দিন পরে তো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীও এসেছিলেন।

সেই কাঁচা বয়সে ছবি তোলার শখ ছিল। ফিল্মরোল ডেভেলপ করতে দিয়ে আসতাম জলপাইগুড়ি শহরে অবস্থিত দিনবাজারের এক সুসজ্জিত স্টুডিয়োতে— মালিক ছিলেন এক জন সৌম্যদর্শন ঝকঝকে পোশাকের ব্যক্তি। বন্যার আগে দুটো রোল জমা দিয়ে এসেছিলাম। ঝড়ঝাপ্টা কমলে ক’দিন পরে ছবির খোঁজে গিয়ে দেখলাম, পুরো বাজারটাই উধাও।

স্টুডিয়োর খোঁজ করতে এক জন আমাকে দেখিয়ে দিলেন এক জন ছেঁড়া পোশাকের উসকোখুসকো মানুষকে— তিনি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা ভাঙা চেয়ারে উদাস হয়ে বসে আছেন। কাছে গিয়ে স্টুডিয়োর মালিককে চিনতে পারলাম— ছবির কথা জিজ্ঞেস করার সাহস অবশ্য আমার হয়নি।

বলাইচন্দ্র চক্রবর্তী

কলকাতা-৬৪

রাবণ দহন

টেলিভিশনের পর্দায় অমৃতসরগামী ট্রেনটাকে তীব্র গতিবেগে অগণিত মানুষের মধ্যে দিয়ে চলে যেতে দেখে আতঙ্কে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। রেল কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার দায় নিতে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা নাকি ভিড়ের বিরুদ্ধে এফ আই আর করেছেন। এখন প্রশ্ন, অত জন মানুষ যে রেললাইনের উপরে জড়ো হয়েছিলেন সে সম্পর্কে রেল কর্তৃপক্ষ কী ভাবে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। রাবণ দহনের অনুষ্ঠান দেখার বদলে যদি তারা রেল লাইনের কোনও ক্ষতি সাধন করত এবং তার ফলে আরও বড় কোনও দুর্ঘটনা (যদি এটাকে ছোট দুর্ঘটনা বলে মনে হয়)— সে ক্ষেত্রেও কি চালক ব্রেক কষে ট্রেন থামাতেন না?

সরকার আর প্রশাসনের দোষ খুঁজতে গিয়েই মনে প্রশ্ন উদয় হল: আমরাও কি কোনও আইন মেনে চলি? ‘আরে ছাড় তো ও কিছু হবে না’— এ আমাদের মজ্জাগত। ট্রাফিক সার্জেন্ট না থাকলে আমরা সিগন্যাল মানব না, হাত দেখিয়ে চলমান গাড়ির স্রোত থামিয়ে যেখান সেখান দিয়ে রাস্তা পার হব। গাড়ির সিটবেল্ট বাঁধব না, হেলমেট পরব না। লাইনের উপরে ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস থাকলেও সর্বদাই রেললাইন পার হব। দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির তলা দিয়ে গুঁড়ি মেরে যাব। এই একটা ব্যাপারে দরিদ্র ভারতবাসী, ডাক্তার ও আইটি প্রফেশনাল ভারতবাসী, কবি ও দালাল ভারতবাসী নিক্তি মেপে সমান অভদ্র ও অশিক্ষিত।

এক অমোঘ নিয়তিবাদ আমাদের মজ্জাগত। আমার কিছু হবে না ভগবান বাঁচাবেন। দুর্ঘটনা অন্যদের হয়, আমি খালি টিভিতে বা খবরের কাগজে খবর দেখে হাহুতাশ করব। এই ভরসাতেই প্রতি বছরের মতো এ বারেও অমৃতসরের মানুষ জড়ো হয়েছিলেন রেললাইনের উপরে, কিন্তু যান্ত্রিক দানব রাম-রাবণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না।

শংকরলাল সরকার

কলকাতা-৩২

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Flood History Jalpaiguri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE