Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: কাব্যিক ভালবাসা

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো আর্জেন্টিনার এক ধনী ও বনেদি পরিবারের কন্যা ছিলেন। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের পাশাপাশি আর একটা বিষয়েও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৫ ০৬:২৩
Share
Save

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শূন্য কেদারা প্রতীক্ষায়’ (২-২) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো আর্জেন্টিনার এক ধনী ও বনেদি পরিবারের কন্যা ছিলেন। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের পাশাপাশি আর একটা বিষয়েও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। তিনি কবির মতো বিদ্যালয়মুখী হননি। ফলে যা কিছু শিক্ষালাভ তা ফরাসি ও ইংরেজ গভর্নেস-এর কাছে। দক্ষ ছিলেন ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায়। ফলে কবির গীতাঞ্জলি ও অন্যান্য সাহিত্যের ফরাসি ও ইংরেজি অনুবাদ পাঠের মধ্য দিয়ে কবির সৃষ্টিশীলতায় মুগ্ধ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বোধ হয় তাঁর অসুখী বিবাহজীবনে চন্দ্রালোক-সম পরশ পেয়েছিলেন। কবির প্রতি বিশেষ অনুরাগের কারণেই কবির সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা করেছেন মাত্র। ডাক্তারের পরামর্শ মতো অসুস্থতার কারণে কবির আর্জেন্টিনায় নামা। কবির সুস্থতা নিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এতটাই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁকে নিজেদের বাড়িতে রেখে সুস্থ করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু বাদ সেধেছিলেন ওকাম্পোর বাবা-মা। বাধ্য হয়ে অনতিদূরে সান ইসিদ্রোয় নদী তীরবর্তী এক আত্মীয়ের নিরিবিলি বাড়ি ‘মিরালরিও’তে কবির থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া সারা দিন সেই বাড়িতে থাকতেন, রাতে আবার বাবা-মায়ের কাছে নিজেদের ভিলাতে ফিরে আসতেন। কবির দেখভালের জন্য কয়েক জন সহায়ককে পাঠিয়ে দেওয়া, কবির অবস্থানকালকে দীর্ঘ করার জন্য পেরু যাত্রা বাতিলের জন্য মরিয়া হয়ে সরকারি যোগাযোগ, নিজের বহুমূল্য অলঙ্কার বিক্রি করা, কবির আঁকা শতাধিক চিত্রের প্রদর্শনী, বেপরোয়া হয়ে সান ইসিদ্রোর ভিলায় রাখা আরামকেদারাটি পাঠানোর ব্যবস্থা করা প্রভৃতি দেখে তাঁর প্রতি ওকাম্পোর অতি সখ্যের বা আসক্তির আভাস পান কবি। পরে জাহাজে বসে এক চিঠিতে বলেছিলেন, তাঁর নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য নারীর ভালবাসার আবশ্যকতা থাকলেও তা অন্য সাধারণ পুরুষদের মতো কামাসক্তি কোনও অর্থেই নয়, তাঁর কাজে সেই প্রেম কেবল প্রেরণা সঞ্চার করে মাত্র। তবে কোনও নারী প্রেম দিয়ে যদি তাঁকে একান্ত বলে ভেবে থাকেন তবে তাঁর বন্ধনভীরু মন তাঁকে প্রত্যাখ্যানেও দ্বিধা করে না।

এমন কঠিন অভিব্যক্তির পরও কবি পূরবী কাব্যগ্রন্থটি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, যিনি কবির কাছে ‘বিজয়া’, তাঁকেই উৎসর্গ করেছেন। লেখকের আলোচনার সূত্রেই বলি, শতবর্ষ পরও শান্তিনিকেতনে রাখা ‘বিজয়া’-প্রেরিত নিঃসঙ্গ আরামকেদারাটি সেই অতি সখ্যের কাব্যিক ভালবাসা বহন করে চলেছে।

স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০

ওগো বিদেশিনি

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শূন্য কেদারা প্রতীক্ষায়’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জানাই যে, বিদগ্ধ, সংবেদনশীল, বহুভাষাবিদ আর্জেন্টিনীয় সুলেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত ও আলোড়িত করেছিলেন। ওকাম্পোও রবীন্দ্রনাথের জীবনে বিশিষ্ট প্রেরণাদাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। ওকাম্পো শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের অনুরাগিণী ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথকে তিনি করেছিলেন তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা। বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক কেতকী কুশারী ডাইসন মনে করেন, আগাগোড়া উভয়ের মধ্যে স্নিগ্ধ এবং সশ্রদ্ধ সম্পর্ক ছিল। তাঁর কথায়, রবীন্দ্রনাথের বিবেচক সংযমের ফলে সম্পর্কটা কোনও পর্যায়েই ঝটিকাক্ষুব্ধ বা বিপর্যস্ত হয়ে যায়নি। রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনীর মতে, কবির অভ্যাস ছিল হৃদয়াবেগের গভীর অঙ্গীকারগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া, কেননা তিনি অনুভব করতেন যে ঈশ্বরের সেবাতেই নিহিত তাঁর কর্তব্য।

তবে সান ইসিদ্রো থেকে রবীন্দ্রনাথ চলে আসার পর ওকাম্পো এক স্মৃতিবিধুরতায় বারে বারেই ফিরে তাকিয়েছেন দিনগুলোর দিকে। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে ৮ অক্টোবর, ১৯২৫ বুয়েনোস আইরেস থেকে লেনার্ড এল্‌মহার্স্টকে লেখা ওকাম্পোর চিঠি— “...তোমরা মিরালরিও ছেড়ে চ’লে যাওয়ার পর থেকে সান ইসিদ্রো ভারী করুণ জায়গা হয়ে গেছে। সেই শূন্য বাড়িটার সঙ্গে নিজেকে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারি না। বাকি সব কিছুকেও শূন্য মনে হয়। বড্ড ব্যথা লাগে...।” (তর্জমা— কেতকী কুশারী ডাইসন)। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর এই বান্ধবী তাঁর সুর পত্রিকায় প্রয়াত সুহৃদ ও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছিলেন এক চিত্তস্পর্শী সচিত্র প্রবন্ধে। ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথকে এক রকম ভাবে ভালবেসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু দূরত্বটুকু অতিক্রম করেননি। আবার কবির প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার তাগিদ থেকেই মূলত ওকাম্পোর উৎসাহ-উদ্দীপনায় আর্জেন্টিনায় রবীন্দ্রশতবর্ষ পালিত হয় নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। উৎসবের অঙ্গ হিসাবে সেমিনার, আলোচনা সভা, নাটক, গান, রবীন্দ্র-জীবন ও সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় রবীন্দ্র স্মারক ডাকটিকিট।

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও উভয়ের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রীতির সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। এই মধুময়-স্মৃতি কবি জীবনের শেষ পর্ব পর্যন্ত বহন করেছিলেন। মৃত্যুর কিছু দিন আগেও তিনি ভিক্টোরিয়ার কথা ভেবেছেন, “বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে /যে প্রেয়সী পেতেছে আসন/ চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া/ কানে কানে তাহারি ভাষণ।/ ভাষা যার জানা ছিল নাকো,/ আঁখি যার কয়েছিল কথা,/ জাগায়ে রাখিবে চিরদিন/ সকরুণ তাহারি বারতা।” (৬ এপ্রিল, ১৯৪১, শেষ লেখা)। রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়ার সম্পর্কের ‘অনুক্ত ইতিহাস’ আজও রহস্যাবৃত। এমন অনেক বিষয় অনুমানের উপর ভিত্তি করে লেখা হচ্ছে, যা নিয়ে রয়েছে সংশয় দ্বিধা দ্বন্দ্ব। বোধ হয় তা কাম্য নয়। প্রয়োজন আরও গবেষণার।

সুদেব মালতিসা, হুগলি

দুই মন

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধটিতে লিখেছেন যে, “পরস্পরকে লেখা চিঠিপত্রই ইঙ্গিত দিয়ে যায় দু’জনের ভিতর গড়ে ওঠা এক বিরল, গহিন ভালবাসার সম্পর্কের, যার অনুক্ত ইতিহাস আজও রহস্যে আবৃত।” সেই বন্ধনকে যথোচিত সম্মান দেখিয়েই এ বারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি সভাপতি আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক-অধ্যাপক পাবলো সিজ়ার তৈরি করেছিলেন তাঁর ছবি থিংকিং অব হিম। তিনিই বলেছেন তাঁর এই ছবি মূলত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর রচনা ও লেখিকা কেতকী কুশারী ডাইসনের গ্রন্থের ভিত্তিতে নির্মিত। তিনি দেখিয়েছেন মেধার দীপ্তিতেই আলোকিত ছিল দুই মন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো তাঁকে ভালবাসেন। তিনি কবিতা লেখেন বাংলায়, ভিক্টোরিয়া শুনতে চান, রবি ঠাকুর তর্জমা করে দেন ইংরেজিতে। দু’জনের মধ্যে তবু ভাষার প্রাচীর, ভিক্টোরিয়ার সাহিত্যিক মন, সে তো না গুছিয়ে কিছু বলতে চায় না, তাই অনেক সময় চুপ করেই থাকত সে!

১৯২৪ সালে খবর এল বুয়েনোস আইরেসেই থাকবেন কবি— “একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী”— যাঁকে এত দিন ধরে দেখতে চেয়েছেন, তাঁকে চোখের সামনে দেখে প্রায় বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন ভিক্টোরিয়া, রবীন্দ্রনাথকে কী ভাবে উপযুক্ত আরামে রাখা যায়, তার জন্য বাড়ি খুঁজতে লাগলেন তিনি। অনেক চেষ্টার পর এক আত্মীয়ের বাড়ি সাত দিনের জন্য ফাঁকা পাওয়া গেল, এ দিকে হাতে পয়সা নেই, নিজের বহুমূল্য হিরে বসানো টায়রাটিকে বিক্রি করে দিলেন খুব কম দামে, তিন মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে দিলেন গৃহকর্তাকে।

এক অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলেন দু’জনে। বাহান্নটি দিন কবি কাটিয়েছিলেন ওকাম্পোর সেবায়, তাঁর কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল, তাঁদের এই বন্ধুত্ব চিরজীবী হয়ে থাকবে, যোগাযোগ ছিল চিঠিতে, সখ্য থেকে গিয়েছিল আজীবন। সান ইসিদ্রোতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গীতাঞ্জলিই ছিল তাঁর চলার পথের সঙ্গী। তিনি শুধু বলতেন, “হি ইজ় অ্যাজ় নিয়ার টু মি অ্যাজ় মাই লাইফ...!”

সৌমিত্র মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindranath Tagore Victoria Ocampo

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}