বিশ্বজিৎ রায়ের ‘সহজ বিশ্বাসের বন্ধনে’ (১৯-১০) প্রবন্ধটি সুখপাঠ্য। ওড়িশার প্রান্তে পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম কসবাগোলার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিযুক্ত ডাক্তার অনিন্দিতা ঝা’কে নিয়ে এই প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে মনে হয়, এমন সেবাপরায়ণ ডাক্তার আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু পাচ্ছি না কেন? সমস্যা কোথায়? প্রবন্ধকার সম্ভবত ডাক্তার ঝা-এর বক্তব্যে এর উত্তর খুঁজেছেন, “এঁদের সঙ্গে কেমন মিশে গেছি।... সামাজিক মানুষ এক সময় ডাক্তারকে বিশ্বাস করতেন, ভালবাসতেন। সেই সম্পর্কটা নানা কারণে হারিয়ে গেছে। তাই হয়তো এত অবিশ্বাস, দুর্নীতির এমন বিস্তার।” এই উক্তির মধ্যে বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতির কোনও গভীর বিশ্লেষণ নেই। আছে এক নিখাদ ভাল মানুষের একান্ত নিজস্ব অনুভূতি। তাই আরও প্রাসঙ্গিক কয়েকটি কথা বলে এই প্রবন্ধের সমাপ্তি ঘটলে ভাল লাগত। কিন্তু কেন প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনলেন, তা বোধগম্য হল না। যদিও বা আনলেন তার যথাযথ বিশ্লেষণ না করায় এত বড় মাপের মানুষের কার্যক্রম সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল না।
এটা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের দেশানুরাগ সমসাময়িক রাজনীতিকদের থেকে স্বতন্ত্র ছিল, তিনি “সমাজকে ভিতর থেকে গড়ে নিতে চেয়েছিলেন।” এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ শ্রীনিকেতনকে যথার্থ ভাবে গড়ে তোলার জন্য তাঁর প্রয়াস। ওই সময়ে কবি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে (৩১-১০-১৯৩০) লিখেছিলেন, “আমাদের সব চেয়ে বড়ো কাজ শ্রীনিকেতনে। সমস্ত দেশকে কী করে বাঁচাতে হবে ঐখানে ছোটো আকারে তারই নিষ্পত্তি করা আমাদের ব্রত। যদি তুই রাশিয়ায় আসতিস এ সম্বন্ধে অনেক তোর অভিজ্ঞতা হত।” সদ্য গড়ে-ওঠা সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখার (১৯৩০) অভিজ্ঞতা-প্রসূত এই উপলব্ধি। সত্যানুরাগী রবীন্দ্রনাথ যা কিছু মহৎ ও উদার তা গ্রহণে সদা উন্মুখ ছিলেন। এ সব নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে। কিন্তু ডাক্তার ঝা-এর বক্তব্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথকে অহেতুক টেনে আনার প্রাসঙ্গিকতা বোঝা গেল না।
তপন কুমার সামন্ত, কলকাতা-১২
বিস্মৃত আদর্শ
বিশ্বজিৎ রায়ের প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক। ডাক্তার অনিন্দিতা ঝা-কে অভিনন্দন জানাই। বর্তমান শহরকেন্দ্রিক বসবাসের যুগে গ্রামে বসবাস করে দরিদ্র জনগণের চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ এক বিরল ঘটনা। গ্রামে চাকরি পেলেও কী ভাবে শহরে ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসা যায়, সেই চেষ্টাই অধিকাংশ চিকিৎসক করে থাকেন। কিংবা, শহর থেকে যাতায়াত করে গ্রামে পরিষেবা দেন। সেই হিসাবে পূর্ব মেদিনীপুরের কসবাগোলা গ্রামের ‘বুড়িমা’ ডাক্তার আমাদের নমস্য। এমন চিকিৎসক কেবল আমাদের রাজ্যে নয়, সারা দেশের প্রতিটি গ্রামে প্রয়োজন। কারণ গ্রামে চিকিৎসকের বড়ই অভাব। তবে কেবল চিকিৎসা নয়, গ্রামের মানুষ একটু সহানুভূতিও খোঁজেন। কারণ গ্রামে কে আছেন, যে তাঁদের সহানুভূতির সঙ্গে দেখবেন? যে চিকিৎসকরা গ্রামে যান, তাঁদের মধ্যে এই অনুভূতিটা খুব দরকার। স্কুলের বাংলা রচনাতে আমরা অনেকেই বড় হয়ে ডাক্তার হওয়া, এবং গ্রামের দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা করার আদর্শের কথা লিখেছি। ওই ছাত্র যখন সত্যি-সত্যি ডাক্তার হয়, তখন সেই আদর্শের কথা ভুলে যায়। না হলে গ্রামে ডাক্তারের অভাব হয় কী করে? বিদ্যাসাগর মহাশয় তো আমাদের পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। অথচ তাঁর আদর্শের কথা পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ। তাকে বাস্তবরূপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, দু’-দশটা গ্রামের মধ্যে এক জন এমবিবিএস বা এলএমএফ পাশ করা ডাক্তার চিকিৎসা করতেন। বর্তমানে এই দৃশ্য বিরল। আগের থেকে গ্রামে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। তবু কেন ডাক্তারবাবুরা গ্রামে যেতে চান না, তা পর্যালোচনা করা দরকার। অথচ অনিন্দিতা ঝা গ্রামেই থেকে যেতে চান। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে গ্রামের মানুষগুলির সঙ্গে একাত্ম হতে না পারলে তাঁর চিকিৎসাও যেন ফলপ্রসূ হবে না। এ জন্য তিনি তাঁদের ভাষাও রপ্ত করে, তাঁদের ভাষায় কথা বলে চিকিৎসা করছেন।
প্রবন্ধকার তাঁর কাজকে রবীন্দ্রনাথের আদর্শের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাস্তবিক রবীন্দ্রনাথ তো বিবেকানন্দের মতো গ্রামের গরিব মানুষদের জাগরণের কথা তাঁর বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন। অনিন্দিতা ঝা সেই কাজটিই প্রত্যন্ত গ্রামে বসে নিঃশব্দে করে চলেছেন। এমন ডাক্তার দেশের প্রতি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হোক।
সুদেব কুমার ঘোষ, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
নিবিড় সম্পর্ক
‘চিকিৎসা’ মানে যে শুধু চিকিৎসা নয়, আরও বেশি কিছু, তারই নমুনা ‘সহজ বিশ্বাসের বন্ধনে’ প্রবন্ধের ছত্রে ছত্রে। লেখাটা পড়তে পড়তে সত্যিই যেন অন্য একটা জগতে পৌঁছে গিয়েছিলাম, যে জগতে চেনা ছকের বাইরে সম্পর্কের অন্য রকম একটা ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ‘সার্ভিস প্রোভাইডার’ আর ‘কনজ়িউমার’-এর সম্পর্কের বাইরে গিয়েও চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে যে একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠতে পারে এ যুগেও, এই প্রবন্ধটি না পড়লে তা সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন হত। আজকাল গ্রাম থেকে শহরে বা বাড়ির কাছাকাছি কোনও জায়গায় বদলির জন্য ডাক্তার, শিক্ষক থেকে শুরু করে সরকারি চাকুরেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এবং লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুরপথে খরচ করতে পিছপা হন না বলে শোনা যায়। সেখানে পূর্ব মেদিনীপুরের কসবাগোলা গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক ডাক্তার দিদিমণি বলেন, “এই সম্পর্ক, এই পারস্পরিক সামাজিকতা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে আমি শান্তি পাব না।” নিজের পেশাগত পরিধির বাইরে গিয়ে যে ভাবে এই চিকিৎসক গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে সামাজিক একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন, তাঁদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন, তাঁদের ভালবাসায় জারিত হয়েছেন, এমনকি তাঁদের ভাষাটুকুও রপ্ত করে ফেলেছেন, সত্যিই তা দৃষ্টান্তমূলক। শিক্ষণীয়।
শিক্ষক ও চিকিৎসক যদি পেশাগত সম্পর্কের বাইরে গিয়ে উপভোক্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাতাবরণ গড়ে তুলতে পারেন, তা হলে উভয়ের পক্ষেই মঙ্গলজনক। সে ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা অবিশ্বাসের অবসানও ঘটে, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোও সম্ভবপর হয়।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
আপনজন
বিশ্বজিৎ রায়ের লেখা প্রবন্ধটি পড়ে মনে পড়ল ছোটবেলায় গ্রামে ‘ডাক্তার জেঠু’-র সঙ্গে আমাদের পরিবারের শ্রদ্ধা সম্মানের সম্পর্কের কথা। মায়ের কঠিন হার্টের অসুখে তিনি আমাদের বাড়িতে এসে দেখেন, ক্লাস ফোরে পড়া আমি ভাতের হাঁড়ি উপুড় দিচ্ছি। আমার শিক্ষক বাবাকে কড়া গলায় বললেন, “ওইটুকু মেয়ে রান্নার কাজ করছে? গ্রামের এ সব জাতপাত ছাড়, যে মহিলা কুটে-বেটে দেয়, সেই রান্না করবে।” এমনই ছিল তাঁর অধিকারবোধ। সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছিল। সত্তর দশকের শেষের দিকে কলেজ যেতে ট্রেনে ওঠার সময় এক মহিলার পেনসিল হিলের চাপে আমার পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ চেপে বসে রক্তে-মাংসে একাকার। বন্ধুরা ধরাধরি করে নামিয়ে বিরাটির এক ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে এল। তিনি ইনজেকশন-ওষুধ দিয়ে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন, আবার দু’দিন বাদে কম্পাউন্ডারবাবুকে বাড়িতে পাঠিয়ে খোঁজ নিলেন যে আমি কেমন আছি।
আমাদের এখানে ছিলেন ভৌমিক ডাক্তারবাবু, যিনি সম্প্রতি মারা গেলেন! পঞ্চাশ বছর ধরে দেখেছি তাঁর চেম্বারে উপচে পড়া রোগীদের ভিড়। তাঁদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত গরিব ঘরের, যাঁদের তিনি বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন, প্রয়োজনে সঙ্গে থাকা ওষুধপত্রও দিয়ে দিতেন। ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসার সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy