Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
তাঁদের মন বোঝা সহজ নয়

মহিলা ভোটের অনুপাত অনেক হিসেব উল্টে দিতে পারে

দেশে মহিলা ভোটারের অনুপাত বেড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ১৯৬২-র লোকসভা নির্বাচনে পুরুষ ভোটদাতা ছিল মহিলা ভোটদাতার চেয়ে ১৬.৬৮% বেশি। ২০০৪-এর নির্বাচনে এই পার্থক্য কমে হয় ৮%।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

বিভিন্ন সামাজিক, প্রশাসনিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভোটের চালচিত্র অবশ্যই বদলায়। এমনকি নির্বাচনের কথা সে ভাবে না ভেবে সংস্কার, কর্মকাণ্ড, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করলেও, বা প্রতিশ্রুতি দিলেও তার প্রভাব ইভিএম-এর বোতামে পড়ে বইকি। তিন তালাক সংক্রান্ত আইন, মুসলিম মহিলাদের পুরুষ অভিভাবক ছাড়াই হজে যাওয়ার অধিকার, শবরীমালা নিয়ে আন্দোলন— মহিলা ভোটারদের মধ্যে এগুলির রাজনৈতিক প্রভাব তো আছেই। পুরুষদের মধ্যেও আছে। ইভিএম-এ প্রতিফলিত হয় উভয়ই। আবার উজ্জ্বলা যোজনা, ক্র্যাড্ল বেবি প্রকল্প, কন্যাশ্রী কিংবা রূপশ্রী প্রকল্পের নির্বাচনী প্রভাব থাকবেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রভাবটা মিশ্রও হতে পারে। ও দিকে সামাজিক সুরক্ষা বা ন্যূনতম আয় যোজনার নির্দিষ্ট পরিবার-ভিত্তিক টাকা যদি পরিবারের প্রধান হিসেবে মহিলাদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দেওয়া হয়, তাতে যে শুধুমাত্র সেই টাকার অপচয়ের সম্ভাবনা কমে বা মহিলাদের সামাজিক প্রভাব বাড়ে, সেটাই নয়, ভোটেও তার একটা ছাপ অবশ্যই পড়ে।

দেশে মহিলা ভোটারের অনুপাত বেড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ১৯৬২-র লোকসভা নির্বাচনে পুরুষ ভোটদাতা ছিল মহিলা ভোটদাতার চেয়ে ১৬.৬৮% বেশি। ২০০৪-এর নির্বাচনে এই পার্থক্য কমে হয় ৮%। আর ২০১৪-য় মহিলাদের থেকে পুরুষ ভোটদাতা মাত্র ১.৪৬% বেশি। এই লোকসভা নির্বাচনে মহিলা ভোটদাতার সংখ্যা হয়তো ছাপিয়ে যেতে পারে পুরুষদের সংখ্যাকেও। প্রথম বারের জন্য। ঘটনাটা ঘটলে তাতে চমক থাকতে পারে, কিন্তু এটা একেবারেই ব্যতিক্রমী নয়। আমেরিকার মতো দেশে মহিলা ভোটদাতার সংখ্যা সাধারণত পুরুষদের চেয়ে বেশি। এর ব্যতিক্রম হয়নি গত আধ শতকে। ২০১৬ সালেও সে দেশে মহিলা ভোটদাতার সংখ্যা ৭৩.৭ মিলিয়ন, আর পুরুষ ভোটদাতা ৬৩.৮ মিলিয়ন।

মহিলা ভোটারের অনুপাত বাড়লে কিন্তু মহিলা-ভোটের গুরুত্বও বেড়ে যায়। মজার কথা হল, আমাদের দেশের মহিলা ভোটাররা কিন্তু মোটের উপর নীরব। প্রায় বোবা-ই বলা চলে। সোশ্যাল মিডিয়ায়, বাস-ট্রামে, অফিস-আদালতে আর পাঁচ জনের কাছে নিজেদের রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ, এবং মতামত প্রকাশ করতে তাঁদের খুবই অনীহা। নির্বাচনের প্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়া উপচে পড়ছে অজস্র রাজনৈতিক পোস্টে— ছবি, ভিডিয়ো ক্লিপ, খবর, মতামত। এর কিছু সত্যি, কিছু আবার বানিয়ে-তোলা, যাকে বলে ‘ফেক নিউজ়’। যারা দেখছে, বা অনেক সময় যারা পোস্ট করছে তারাও বড় একটা জানে না এগুলোর সত্যতা। আর যদি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ-এর বাইরের কথা বলি, প্রথাগত মিডিয়া অর্থাৎ টিভি বা সংবাদপত্রেও মেয়েদের মত প্রকাশের পরিমাণটা বড্ড কম। ফলে ভোটের মুখে ‘হাওয়া’ বলে আমরা যেটা দেখি, সেটা অনেকটাই হয়তো ওই অর্ধেক সংখ্যক পুরুষ ভোটারের মতো। বাকি আধখানা ‘হাওয়া’ থাকে সযত্নে লুকানো। সুতরাং, শেষ ছবিটা অবশ্যই বদলে যেতে পারে যদি মহিলা ভোটারদের পছন্দ-অপছন্দ এবং ভোট হয় অন্য রকমের।

মোটের উপর মেয়েদের ভোটের গতিপ্রকৃতি কি তা হলে পুরুষের উল্টো দিকে? তাও ঠিক নয়। বলা যেতে পারে, গতিটা কিছুটা ‘অন্য রকম’। এবং একেবারেই পুরুষ-নিরপেক্ষ। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে সিএসডিএস-এর এক স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৭০% মহিলা তাঁদের স্বামীর মতামতের উপর ভিত্তি করে ভোটটা দেন না। কেউ মনে করেন, এই শতাংশটা ৮০-র বেশি হওয়াও সম্ভব। কে জানে, হয়তো আরও বেশি। তাই সমস্ত জনমত, হইচই, সম্ভাব্য ভোটের হিসাব-নিকাশ, সবই অর্ধেক আকাশে ঘুরপাক খায়। সর্বার্থেই।

এবং পুরুষ-নারী ভেদে ভোটের ছবিটা বদলাতে পারে অনেকটাই। কোনও দল (বা প্রার্থী) পুরুষ-ভোটের কত শতাংশ পেলেন আর মহিলা-ভোটের কত শতাংশ পেলেন, তার বিয়োগ-ফলটাকে বলে ‘ভোটিং জেন্ডার গ্যাপ’। বাংলায় বলা যাক, ‘সমর্থনের লিঙ্গ-বৈষম্য’। মার্কিন দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থীরা বেশি সংখ্যক মহিলা-ভোট পেয়েছেন চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে। সত্তরের দশক থেকেই মেয়েদের ভোট ক্রমশ ঢলে পড়ে ডেমোক্রাট প্রার্থীদের দিকে। এর পিছনে অবশ্যই ছিল মেয়েদের সমান অধিকারের বা গর্ভপাত সংক্রান্ত সামাজিক-রাজনৈতিক তরজা। ১৯৮০-র নির্বাচনে রেগান জিতলেও মেয়েদের ভোটে ৮% এগিয়ে ছিলেন জিমি কার্টার। সেই থেকে সে দেশে সমর্থনের লিঙ্গ-বৈষম্যের গড় পরিমাণটা ওই ৮%-ই। গত নির্বাচনে হারলেও হিলারি ক্লিন্টন ১৩% বেশি পেয়েছেন মেয়েদের সমর্থন। হিলারি মহিলা-ভোট পেয়েছেন ৫৪%, আর পুরুষ-ভোট মাত্র ৪১%।

ভারতের ছবিটা একটু দেখা যাক। ২০১৪’র নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩৩% পুরুষদের ভোট, আর মাত্র ২৯% মহিলা-ভোট। আপাতদৃষ্টিতে ফারাকটা খুব বড়সড় না ঠেকলেও, ৪% মহিলা-ভোটের পার্থক্য মানে মোট ভোটে মোটামুটি ২% পার্থক্য। আর আমাদের দেশের নির্বাচনী কাঠামোতে এই তফাতটা কিন্তু নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে অনেক ক্ষেত্রেই। ও দিকে কংগ্রেস পুরুষ এবং মহিলা, দু’পক্ষেরই ১৯%-র সমর্থন পেয়েছে। বিএসপি বা তৃণমূলের মতো দলের আবার মহিলা-সমর্থন বেশি। প্রণয় রায় আর দোরাব সোপারিওয়ালা-র যে সাম্প্রতিক বই ‘দ্য ভার্ডিক্ট’ প্রকাশিত হয়েছে গত মাসে, তাতে দেখানো হয়েছে, ২০১৪-র নির্বাচনে মোটের উপর এনডিএ প্রার্থীরা ইউপিএ প্রার্থীদের থেকে ১৯% বেশি সমর্থন পেয়েছেন পুরুষ ভোটারদের মধ্যে। ও দিকে মহিলা ভোটারদের মধ্যে এনডিএ প্রার্থীরা ইউপিএ প্রার্থীদের চাইতে মাত্র ৯% বেশি ভোট পেয়েছেন। তাই এমনকি আমাদের দেশেও ভোটের দুনিয়ায় পুরুষ-নারী যে দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র সত্তা, হয়তো বা পরস্পর-নিরপেক্ষও, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও কারণ নেই। কতটা হতে পারে এই ভিন্ন সত্তার প্রভাব? প্রণয় রায় এবং দোরাব সোপারিওয়ালা দেখিয়েছেন, গত নির্বাচনটা যদি শুধুমাত্র পুরুষ ভোটারদের ভোটেই হত, তা হলে এনডিএ পেত ৩৭৬টি আসন। ও দিকে যদি শুধু মহিলারাই ভোট দিত গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে, সে ক্ষেত্রে এনডিএ পেত ২৬৫টি আসন।

শুধুমাত্র বিজেপির ক্ষেত্রে অঙ্কটা কষেছি আমি। ২০১৪-তে যদি মহিলাদের মধ্যে বিজেপির ভোট ৪% বাড়ত, তাদের আসনসংখ্যা ২৮২ থেকে ২৯১-এ দাঁড়াত। আর যদি ৮% মহিলা-ভোট বাড়ত, তারা একাই পেতে পারত ২৯৯টি আসন।

তবু, ভারতবর্ষের মতো সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় বৈচিত্রের দেশে ‘মহিলা ভোটার’ তো একটি অখণ্ড সত্তা হতে পারে না। যে মহিলাকে রোজ কয়েক মাইল হেঁটে জল জোগাড় করতে হয়, তার আর কর্পোরেট অফিসে কর্মরতার দুনিয়া যেমন পুরোটাই আলাদা, পুরোদস্তুর পার্থক্য থাকবে তাদের ভোটের বিষয়েও। তবু, মেয়েদের কাছে ভোটের বিষয়গুলি হয়তো একটু অন্য রকম। পুরুষ-নারীর সংবেদনশীলতাও হয়তো ভিন্ন মাত্রায়। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক বিভিন্ন বিষয় হয়তো মেয়েদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমনকি রাজ্যে আইন করে মদ বন্ধ করার মতো ঘটনার কী প্রচণ্ড নির্বাচনী প্রভাব থাকতে পারে তা ২০১৫-য় বিহারে নীতীশ কুমারের পুনর্নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। মহিলারা দলে দলে ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন নীতীশকে। একের পর এক মহিলা-কেন্দ্রিক সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প জয়ললিতার মহিলা ভোট-ব্যাঙ্ক মজবুত করে গিয়েছে। ১৯৯২-এ ক্র্যাড্ল বেবি প্রকল্পের মধ্য দিয়ে যার শুরু বলা যেতে পারে। তার পর মহিলাদের ফ্রি মিক্সার-গ্রাইন্ডার আর ফ্যান বিতরণ, বৃদ্ধা বিধবাদের ভাতা বাড়ানো, সরকারি হাসপাতালে নতুন মায়েদের জন্য সস্তায় বেবিকেয়ার-কিটের ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রকল্প।

মোটের উপর মহিলা ভোট যে গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশ অন্য রকম, সেটা অবশ্যই বুঝেছে প্রায় সকল প্রধান রাজনৈতিক দল। তাদের নিজেদের মতো করে যতটা সম্ভব বেশি এই অর্ধেক আকাশের সমর্থনের অধিকার নেওয়ার একটা প্রচেষ্টা তাই থাকবেই। তবে, কোনও কিছুই বোধ হয় সার্বিক হতে পারে না। যেমন, আশির দশক থেকে মার্কিন দেশে যখন মহিলারা ডেমোক্রাটদের বেশি করে ভোট দিতে শুরু করে, একই সঙ্গে অনেক পুরুষ ভোটার কিন্তু ঝুঁকে পড়ে রিপাবলিকানদের দিকে। সমাজ এক মজার জায়গা, নিরন্তর টানাপড়েনের লড়াইক্ষেত্র। রাজনৈতিক দলগুলি এটা বুঝলে তাদেরই মঙ্গল।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা-র রাশিবিজ্ঞানের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Female Voter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE