Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
নির্বাচনে পক্ষ অবলম্বন করা জরুরি, নোটার অর্থ অপক্ষপাত নয়
general-election-2019/national

নোটা ভাবনা ভোটারদেরই

কিন্তু ভোট না-দেওয়া যে অন্য কোনও কারণে নয়, শুধুমাত্র কোনও প্রার্থী বা দলই পছন্দসই না হওয়ার কারণে— সেটি জানানোর জন্যই নোটার প্রয়োগ।

সংহিতা কুণ্ডু
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৯ ২৩:৪১
Share: Save:

ভোট বাতিল হয়েছে ভেলোরে। তার পরও তামিলনাড়ুতে উদ্ধার হচ্ছে টাকা। জনগণের ভোট কিনে নিতেই নাকি টাকার এই হরির লুট। লিড দিতে পারলে পুরস্কার— ঘোষণা করছেন নেতারা। অন্য দিকে এই রাজ্যের দ্বিতীয় দফা ভোটে নজিরবিহীন ঘটনা দেখা গেল দার্জিলিঙের চোপড়ায়। ভোট দিতে চেয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখালেন সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ জনগণ। এক দিকে নোটের খেলা, আর এক দিকে স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের ইচ্ছা। তৃতীয় পথটি নোটা। এই ত্র্যহস্পর্শের মধ্যে জনগণের ভূমিকাটি কী রকম হবে তা জানা যাবে ভোটের পরে। কিন্তু সাত দফায় কণ্টকিত, ছাপ্পা ভোট এবং বাহিনী-বিতর্কে উত্তপ্ত এই ভোটেও আপাতত ভোটারদের অস্তিত্বেরই সগর্ব ঘোষণা দেখা যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতার পাশাপাশি আর একটি বস্তু অত্যন্ত জরুরি। ভোটে জনগণের অংশগ্রহণে পক্ষপাত প্রকাশ।

রাজনৈতিক দলগুলির কাছে যে হেতু পক্ষে ও বিপক্ষে ভোটদানের পরিসংখ্যানই গুরুত্বপূর্ণ, তারা ভোটারদের ভোট কিনতে চাওয়ার চেষ্টা চালায়। সংসদীয় নির্বাচন-ব্যবস্থার কাঠামোটি দাঁড়িয়ে আছে নিখাদ পক্ষপাতিত্বের উপরেই। এই পরিস্থিতিতে জনগণ কি কোনও ভাবে অপক্ষপাত দেখাতে পারে?

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এখন ভারতের সব নির্বাচনেই ব্যবহার হচ্ছে নোটা। নোটা ব্যাপারটি কী? ইভিএম মেশিনের প্রার্থী তালিকার কাউকেই যদি ভোটারের পছন্দ না হয়, তা হলে তাঁর সার্বিক অপছন্দটিও তিনি গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করেই জানাতে পারবেন— নোটায় ভোট দিয়ে। নির্বাচনের সব থেকে মজার বিষয়টি হল, ভোটে যদিও প্রার্থীরাই জয়ী হন, কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রে সাধারণত ভোটাররা ভোট দেন পার্টিকে, প্রার্থীকে নয়। রাজনৈতিক দলগুলি একটি নির্বাচন কেন্দ্রে এক জনের বেশি প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে পারে না। ফলে একটি পার্টি বা দলের একাধিক প্রার্থীর মধ্যে বাছাইয়ের সুযোগ নেই। নির্দল প্রার্থীদের অবশ্য দলীয় ব্যানার থাকে না। স্থানীয় সংস্থাগুলির নির্বাচন ছাড়া খুব বেশি ভোট সেখানে পড়েও না। তা হলে প্রার্থী অপছন্দের বিষয়টি বদলে গিয়ে দাঁড়াল পার্টি বা দল অপছন্দের বিষয়ে। দলগুলির নিজস্ব ইস্তাহার আছে। মতাদর্শ এবং ভাবমূর্তিও আছে। ভোটারদের যদি সে সবের কোনওটিকেই উপযুক্ত মনে না হয়, তবে ভোট দিতে না গেলেই তো চলে? কিন্তু ভোট না-দেওয়া যে অন্য কোনও কারণে নয়, শুধুমাত্র কোনও প্রার্থী বা দলই পছন্দসই না হওয়ার কারণে— সেটি জানানোর জন্যই নোটার প্রয়োগ।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কিন্তু কোনও দলকেই পছন্দ হচ্ছে না কেন? একটি শাসক দল তো কমপক্ষে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে সরকার চালিয়েছে! জনগণের ভোটেই সেই অধিকার হস্তগত হয়েছিল সন্দেহ নেই। তা হলে নোটা প্রয়োগ করে দুটো বিষয় জানাতে চাওয়া হচ্ছে। প্রথমত শাসক দলকে আর পছন্দ নয়। দ্বিতীয়ত শাসক দলকে প্রতিস্থাপন করার জন্য কোনও রাজনৈতিক দলই বিকল্প হিসেবে উপযুক্ত নয়। এই মনোভাব শাসক দল আর বিরোধী দলের থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখছে। অর্থাৎ নেতিবাচক ভাবে হলেও এ-ও এক ধরনের সমদর্শিতা। নিরপেক্ষতার কাছাকাছি অবস্থান। তা হলে নির্বাচন হবে কিসের ভিত্তিতে? জনগণের যেটুকু অংশ এখনও মনে করে, বিকল্পসন্ধানের যৎকিঞ্চিৎ যা সুযোগ পাওয়া যায়, তাতেই ছাই উড়িয়ে অমূল্যরতনের খোঁজ চালাবে, সেটুকু নিয়েই সংসদীয় গণতন্ত্রকে টিকে থাকতে হবে। এ বার দু’দিক থেকেই জনগণের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। বিকল্প সন্ধান করতে গেলে প্রথমত স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের ইচ্ছাটিকে জাগ্রত রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেই ইচ্ছাটিকে কলুষমুক্ত রাখতে হবে। তৃতীয়ত, যে কোনও একটি পক্ষ অবলম্বন করতে হবে।

কোনও পক্ষই অবলম্বন না করার পক্ষে প্রথম যুক্তিটি ছিল শাসক দলের প্রতি অনাস্থা। রাজনৈতিক ভাষায় একে বলা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বিরাগ। ‘অ্যান্টি-ইনকামবেনসি ফ্যাক্টর’, যা গণতন্ত্রসম্মত উপায়ে পরিবর্তন আনতে কার্যকর। শাসক দলের প্রতি অনাস্থা বা বিরাগ অন্য কোনও দলের পক্ষে ভোটে বদলে যায়। রাজনৈতিক ভাষায় এ ব্যাপারটি হল নেতিবাচক ভোট। জনগণ নেতিবাচক ভোট দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম অপছন্দের দলকে নির্বাচিত করতে পারে। অতএব ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বিরাগ অন্য দলের পক্ষে সুবিধাজনক এবং নিঃসন্দেহে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বিপজ্জনক। সেই বিপজ্জনক পরিস্থিতি যদি নোটার কল্যাণে উতরে যাওয়া যায়, তবে মন্দ কী? বিরাগের ভোট জমা হতে থাক নোটার হাতে। ক্ষমতাসীন দলের ভোট নোটা কমিয়ে দিতে পারে ঠিকই। কিন্তু বিকল্প কোনও দলের ভোট বাড়ায় না। নোটা প্রার্থী বা দল নয়। শতাংশের বিচারে নোটাতে সর্বোচ্চ ভোট পড়লেও যে প্রার্থী পরবর্তী সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনিই জয়ী। যত দিন না এই পরবর্তী ভোটকে নির্দিষ্ট পাশ মার্কস-এ বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, আর তাতে উত্তীর্ণ না হলে নতুন করে ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তত দিন নোটার বোতাম ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বিরাগের প্রায়োগিক গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে কি না তা ভাবনার বিষয়।

আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, বড় সংখ্যায় নোটায় ভোট পড়ার সম্ভাবনা বাড়লেও তা নিয়ে দলগুলি বিশেষ মাথা ঘামাচ্ছে না। যদিও সকলেই নাকি অল্পবিস্তর চিন্তিত। অথচ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, হুমকি এবং বাহুবল প্রদর্শনেও কমতি নেই। আবার দেশ জুড়ে নোটায় ভোট দেওয়ার জন্য প্রচার অব্যাহত। তা হলে নোট ছড়ানো আর নোটার প্রচার ছড়ানো কি একই মুদ্রার দু’টি পিঠ? কী রকম ভাবে? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। দু’টি দলের মধ্যে ভোট। ভোটদাতার সংখ্যা তিন। যদি নোটা-সহ দু’টি দলই একটি করে ভোট পায়, তবে নোটা না থাকলে ভোট এ রকম হতে পারত— ক্ষমতাসীন দল: ১টি ভোট, বিরোধী দল: ২টি ভোট (বিরোধী দলের নিজস্ব একটি ভোট এবং নোটার একটি ভোট)। এ রকম নেতিবাচক ভাবে নিকটতম বিরোধী দলকে ক্ষমতা-দখল থেকে বঞ্চিত করার সুবিধা পাওয়া গেলে ক্ষমতাসীন দল যে নোটার প্রচার অব্যাহত রাখতে তলায় তলায় আগ্রহী থাকবে, তা কি অস্বীকার করা চলে? কারণ টাকার নোট ছড়িয়ে, অথবা ছাপ্পা কিংবা হুমকি দিয়ে ভোট হাতাবার মতো করেই নোটাও কার্যত ক্ষমতাসীন দলের পক্ষেই কাজ করবে।

নোটায় ভোট দেওয়ার আগ্রহ বাড়লে তা আদপে ভোটারদের পক্ষেই ভাবনার বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলির যেমন উচিত জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বিকল্প তৈরি করা, জনগণেরও জেনে রাখা দরকার, সব ক’টি দলের অযোগ্যতা প্রমাণ করার ফলে যে অরাজক শূন্যতা প্রতিষ্ঠা পাবে, তা অতিক্রম করার কোনও দিক্‌নির্দেশ কিন্তু কোথাও নেই। ১৯৫০ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনকে সংশোধন করার উপযুক্ত আইনি সংস্থান তো দূরের কথা। তিন দফা ভোট এখনও বাকি। আরও অনেক প্রচার। অনেক কুকথা। অনেক জবরদস্তি। তবুও স্বাধীন ভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য জনগণের তৎপরতায় রাজনীতি এবং গণতন্ত্র অন্তত চক্ষুষ্মান হোক। মনে রাখা ভাল, আজ যাঁরা জবরদস্তিতে নিজেদের ভোটাধিকার প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, কাল তাঁরা সুযোগ পেলে কিন্তু নোটায় ভোট দেবেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE