Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

বঙ্গজীবনে ভোট: ফেবু যদি চণ্ডীমণ্ডপ তো হোয়াটসঅ্যাপ বাঁশবাগান

হোয়াটসঅ্যাপের উড়ো পোস্টের কল্যাণে সকলেই এক এক জন দক্ষ সেফোলজিস্ট। হোয়াটসঅ্যাপের উড়ো পোস্টের কল্যাণে সকলেই এক এক জন দক্ষ সেফোলজিস্ট।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৯ ১৬:১৭
Share: Save:

ভোটদান আমজনতার কর্ম। ব্যতিক্রমীদের কি ভোট দেওয়া সাজে? এহেন সরল প্রশ্নটি মনে ঘুরপাক খাচ্ছে ক’দিন ধরেই। বাঙালির জাতিগত মুদ্রাদোষ নিজেকে ব্যতিক্রমী হিসেবে প্রতিপন্ন করা, এই সত্য কে না জানে! কিন্তু সেই সত্য ভোটদানের ক্ষেত্রে কতটা খদর বদর করছে, এই ‘হট’ ভোটের বাজারে জেনে রাখা ভাল। এই কৌতূহল নিরসনের সর্বোৎকৃষ্ট ক্ষেত্র হলো ফেসবুক। আপনার মুখ আপুনি দেখিবার এ হেন দর্পণে গত মাস দুয়েক ধরে বং-ব্যতিক্রমীরা যা চর্চা করেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য।

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের মোদ্দা পয়েন্ট হল— মোদী অর নন মোদী। ব্যতিক্রমী বাঙালি আর যাই হোক নিজেকে বিজেপি দেখতে একেবারেই ভাল বাসে না। রং দে গেরুয়া-য় গা ভাসালে যে ব্যতিক্রমের সিলমোহর ছুটে যাবে, তা সে হাড়ে-হম্মে জানে। কিন্তু কম-বেশি দুই দশকের জীবদ্দশায় তৃণমূল প্রশাসনও তো ব্যতিক্রমের মর্যাদা হারিয়েছে। অতঃপর কী করা যায়! গত মাস দুয়েকের ফেবু-চর্চা এই দুই বাইনারির মাঝখান দিয়ে খুব সাবধানে চলেছে। টাইট রোপ ওয়াক। একটু বেসামাল হলেই ধপাস। সিপিএম নৈব নৈব চ। কংগ্রেসের অস্তিত্ব বর্তমান— এই তথ্য কোনও ভাবে উঁকি দিলেও ডিস্কোয়ালি। খেলা থেকে সোজা আউট। ফলে ব্যাপার আরও ঘোরঘট্ট। বাইনারির উপরে বাইনারি। এক অদৃশ্য চতুষ্কোণের ছিনিমিনি টানে বাঙালির ২০১৯।

ফেসবুকের প্রকাশ্যপনার বাইরেও খেলা রয়েছে। সেই খেলা ঘুরছে হোয়াটসঅ্যাপে। তার রকম-সকম একেবারেই ফেবু-র চাইতে আলাদা। যে কথা ফেবু-র চণ্ডীমণ্ডপে বলা যায়নি, সেই গোপন কথাটিকে রবে না গোপনে করতে হোয়াটসঅ্যাপের বাঁশবাগান। কানে কানে ফিসির ফিসির। ওপেন আর গোপেনের এই বাইনারিতেও বং ব্যতিক্রমীরা দেদার সামিল। ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজার। ফেবু-তে যদি কেউ লিখলেন হিন্দুত্ববাদের পিণ্ডদান, তো প্রায় একই সময়ে তিনি ফরওয়ার্ড করে দিলেন হোয়াটসঅ্যাপে আগত ভারতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের এক কাল্পনিক পরিসংখ্যান। ভেবে করলেন, না কি না ভেবেই বোতাম দাবিয়ে ফরওয়ার্ড করে দিলেন অভ্যাসের বশে— বলা কঠিন। কিন্তু করলেন। এই ভাবেই বং ব্যতিক্রমীদের এক হাত চরম দক্ষিণীদের বিরুদ্ধে তো আর এক হাত উদ্ভট, গোলমেলে সব সোশ্যাল পোস্টের ধূসরিমায়। একে দ্বিচারিতা বলবেন? নাঃ অত সহজ নয় ব্যাপারটা।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

আরও পড়ুন: ননসেন্স! ভোটগণনায় ১০০ শতাংশ ভিভিপ্যাট মিলিয়ে দেখার আর্জি খারিজ করল সুপ্রিম কোর্ট

বং ব্যতিক্রমী নিজে ভোট দেবেন কি দেবেন না, সেটা বড় কথা নয়। ভোটের আবহাওয়ার মধ্যে তাঁর নিজস্ব অবস্থিতিটাই আসল কথা। সে দিক থেকে দেখলে বাঙালির চাইতে বড় ‘অস্তিত্ববাদী’ আর কে রয়েছে এই মর ত্রিভুবনে? নিজ-অস্তিত্বে যেখানে কোনও সুড়সুড়ি লাগার সম্ভাবনা নেই, সেই পথ সে কখনও মাড়ায়নি। ফলে মোদী-নন মোদীর খেলায় নিজের অবস্থানটা (এখানে লাইক ও কমেন্ট) সিকিওরড কি না, তা জেনে-বুঝেই সে খেলায় নেমেছে। ব্যতিক্রমীর হাতে সব থকে বড় অস্ত্র ‘হিন্দুত্ব’। কিছুতেই নিজেকে ওই জালে জড়িয়ে ফেলা যাবে না। ফেবু-র পোস্টে ভোটহীন নিশিদিনেও এই নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ নৈমিত্তিক। চরম দক্ষিণ না হোক, নরম দক্ষিণকেও কতটা নিজ-অস্তিত্বে স্থান দিতে হবে, সেই মাপজোকও এরই মাঝে করে নিতে হয়েছে। অন্যের ভোট কোথায় পড়বে— এই নির্দেশিকা তাঁরা দিয়ে চলেছেন গত মাস দুয়েক ধরে।

আরও পড়ুন: সঙ্ঘ নেতা সুনীল জোশী হত্যাকাণ্ডে ফের বিপাকে পড়তে পারেন সাধ্বী প্রজ্ঞা

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বং ব্যতিক্রমীদের সবথেকে বড় আহ্লাদটি হল, কাকে ভোট দেবেন না, সেটা নির্ধারণের একটা ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। ফেবু জুড়ে এই প্রকার পোস্টের দাপাদাপি— অমুককে ভোট দেওয়া যাবে না। তারা নাকি গণতন্ত্র ধ্বংসকারী। ভাল কথা। কিন্তু, কে কোথায় ভোট দেবেন কি দেবেন না, এই ফতোয়া যাঁরা দেন, তাঁরা কোন হিসেবে ‘গণতন্ত্র’-প্রেমী? এ কথা কি তাঁরা বুঝছেন না, যে বা যাঁরা ওই বিশেষ রাজনৈতিক দলটিকে ভোট দেবেন বলে বদ্ধপরিকর, তাঁরা কেউই প্রায় তাঁদের ফেবু ফ্রেন্ড লিস্টের বাসিন্দা নন। ব্যতিক্রমীদের পোস্টে তাঁদের কিস্যু যায় বা আসে না। তাঁরা কোথায় ভোট দেবেন, তাঁরা জানেন। এবং কোনও রকমের নির্দেশিকা যে তাঁদের প্রতিজ্ঞা থেকে চ্যুত করতে পারবে না, তা-ও তাঁরা ভাল মতোই জানেন। তা হলে কেন এই কেরদানি-কসরৎ? নিজস্ব বৃত্তে দাঁড়িয়ে হাততালি-বাহবা কুড়নোর বাইরে আর কিছু এই সব পোস্টের দ্বারা সাধিত হবে বলে মনে হয় না। যে কিসিমে ব্যতিক্রমী বং অলটারনেটিভ সিনেমা নিয়ে পোস্ট দেন, বাংলা সাম্প্রতিক কবিতা নিয়ে তাঁর সুচিন্তা ব্যক্ত করেন, তার চাইতে এক ইঞ্চি বেশি বা কম নয় এই সব পলিটিক্যালি কনশাস পোস্ট। নিজের ‘রাজনীতি সচেতন’ সেলফকে এগিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য এর দ্বারা সাধিত হয় বলে মনে হয় না। এখানেও সেই আত্মকণ্ডূয়নের করুণ কাহিনি।

বঙ্গজীবনে ফেসবুক যদি ঘাত হয়ে থাকে, হোয়াটসঅ্যাপ তবে অন্তর্ঘাত। ফেসবুক চওড়া সড়ক হলে হোয়াটসঅ্যাপ অন্ধিগলির শর্টকাট। গত কয়েক মাস ধরেই বিবিধ রাজনৈতিক দলের আইটি সেল থেকে সত্য-মিথ্যা-অর্ধসত্য মিশ্রিত সব মেসেজ আগ্নেয়গিরি নিঃসৃত লাভাস্রোতের মতো সঞ্চরমান থেকেছে।ব্যতিক্রমীদের মোবাইল থেকেও যে এই সব আধা-গুজব, আধা-ভবিষ্যদ্বাণী অন্যের মোবাইলে গড়িয়ে যায়নি, এ কথা বলা যাবে না। কার সমর্থনে কী ফরওয়ার্ড করছেন, অনেক সময়ে সেই খেয়ালটাও থাকেনি। উদোর পিন্ডি প্রায়শই বুধোর ঘাড়ে চেপেছে। এমনই একজন, যিনি নিজেকে চরমতম সেকুলার বলে ফেবু-তে জাহির করেন, তাঁর মোবাইল থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিদের কাল্পনিক পরিসংখ্যানের পোস্ট পেয়ে তাঁকে ফোন করা হয়। তিনি স্মার্টলি জবাব দেন—“অভ্যাসে ফরওয়ার্ড হয়ে গিয়েছে”। আসলে তিনি এর বিরোধিতাই করতে চেয়েছিলেন। প্রতিবাদী পোস্টটা লিখব-লিখব করেও লেখা হয়নি। ফাঁকতালে কিছু ফেক পোস্ট আর গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়েছে।

হোয়াটসঅ্যাপে যে সব থেকে বেশি ছড়িয়েছে, তা ভোট সংক্রান্ত সমীক্ষা। কে কোথা থেকে এই সব ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, সে খোঁজ নেওয়ার তাগিদ কারোর নেই। হোয়াটসঅ্যাপের এই সব উড়ো পোস্টের কল্যাণে সকলেই এক এক জন দক্ষ সেফোলজিস্ট। ট্রামে-বাসে-শেয়ারের ওলা-উবারে বড় বড় নস্ত্রাদামুস প্রায় সকলেই। বং ব্যতিক্রমীরাও এখানে ব্যতিক্রম নন। তাঁরাও হোয়াটসঅ্যাপ মারফত জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়ে নেমে পড়েছেন রঙ্গমঞ্চে। বাজার গরম। কিন্তু ব্যতিক্রমী বং তাঁর ইন্ডিভিডুয়ালিটির পিন্ডি পাকিয়ে এতে যে আমজনতার স্রোতেই গা ভাসালেন, তা টের পেলেন কি?

এ ভাবেই যাবে রেজাল্ট পর্যন্ত। তার পরে আবার যে কে সেই। অল্টারনেটিভ সিনেমা আর বাংলা কবিতার ঘোরতর দুর্দিন নিয়ে পাঁচ বছর ধরে পোস্টাবেন। মাঝখানে অবশ্য বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। তাতে পণ্ডিতির সুযোগ পাওয়া যাবে। এর বাইরে আর কী! সেই তো গড্ডলিকা প্রবাহ আর তা থেকে নিজের গা বাঁচিয়ে চলার হাঁচোর-পাঁচোর প্রচেষ্টা। থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়।

বড়ই একঘেয়ে এ বঙ্গজীবন! ধুসসসস!! ভাল্লাগে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE