দিদিকে বলিবার ত্রিশ দিন পূর্ণ হইল। গত জুলাই মাসে আজিকার তারিখে নজরুল মঞ্চের দলীয় সভায় দাঁড়াইয়া সর্বজনগ্রাহ্য দিদি অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণের ক্ষোভ-অভিযোগ-চাহিদা-প্রত্যাশা ইত্যাদি প্রকাশের এই সহজ পথটি খুলিয়া দেন। ‘দিদিকে বলো’র নির্দিষ্ট ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইমেল ঠিকানা প্রকাশ করিয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা জানাইয়া দিয়াছেন, কোনও বিষয় সরাসরি তাঁহার গোচরে আনিতে আর কোনও অসুবিধা থাকিবে না। প্রতিকারও ত্বরান্বিত হইবে। গত এক মাসের অভিজ্ঞতায় তাঁহার সেই প্রতিশ্রুতিকে শূন্যগর্ভ বলা যাইবে না। বস্তুত আলোচ্য সময়কালে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচির সুবাদে জনগণের বিস্তর অভিযোগ-অনুযোগ যেমন জমা পড়িয়াছে, তেমনই বেশ কিছু ক্ষেত্রে সুরাহাও মিলিয়াছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, প্রথম দিনেই নাকি দিদির নিকট আবেদন-নালিশের সংখ্যা লক্ষের ঘরে পৌঁছায়। যাহা লক্ষণীয়। কারণ ইহাতেই স্পষ্ট, প্রাপ্য হইতে বঞ্চিতদের তালিকা কত দীর্ঘ! অর্থাৎ কত মানুষের কত কী বলিবার কথা, কত কিছু না-পাইবার ক্ষোভ ছিল বা আছে। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় দৃষ্টি এড়ায় না। তাহা হইল, প্রতিবিধান পাইতে হইলে ‘দিদি’ পর্যন্ত পৌঁছাইতে হইবে। তথাপি সামগ্রিক বিবেচনায় এই উদ্যোগের ‘সদর্থক’ দিকটি অনুধাবন করিতে ‘দিদি’র রাজনৈতিক বিরোধীরাও ভুল করেন নাই। হয়তো তাই রাজ্যের বিজেপি-প্রধানকে ‘চা-চক্র’ বসাইতে হইয়াছে। বাম ও কংগ্রেস বিধানসভায় ‘মুখ্যমন্ত্রীকে বলছি’ জাতীয় পাল্টা কর্মসূচি গ্রহণের পরিকল্পনা করিয়াছে।
অনস্বীকার্য যে, মমতা বরাবর তাঁহার দল ও সরকার দুইয়েরই প্রতীক-পরিচিতি বহন করিয়া আসিতেছেন। তৃণমূল বলিতে মমতা। বর্তমানে সরকার বলিতেও তিনি। ভোটের ময়দানে নিজেকে দলের একমেবাদ্বিতীয়ম্ মুখ হিসাবে তুলিয়া ধরিতে তাঁহার নিজেরও কোনও দ্বিধা নাই। নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চে তিনি অকপটে বলিয়া থাকেন, ‘‘প্রার্থী নয়, আমাকে ভোট দিন।’’ এই প্রবণতার পিছনে একনায়কত্বের ছায়া কতখানি গভীর, তাহা ভাবিবার বিষয়। তবে দলনেত্রীর প্রবল আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করিয়া তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা প্রায় সকলেই এই বোধে আশ্বস্ত থাকেন যে, দিদি ‘রাখিলে’ মারিবার কেহ নাই! প্রশ্ন হইল, সব সমস্যা, অপারগতা, অপূর্ণতা নিরসনের দায়ভার একা মুখ্যমন্ত্রীকে বহন করিতে হইবে কেন? প্রচেষ্টা যতই সাধু হোক, সুফলের আশায় সর্বদা কেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দুয়ারে ঘণ্টা বাজাইতে হইবে?
সরকার পরিচালনায় মন্ত্রীদের সম্মিলিত দায়বদ্ধতা রহিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীর পদটি সেখানে ‘ফার্স্ট অ্যামং ইকুয়ালস’ বা সমমর্যাদাসম্পন্নদের মধ্যে প্রথম বলিয়া স্বীকৃত। কিন্তু তিনিই একা সকল কাজের কাজি হইয়া উঠিলে বাকিদের করণীয় বলিয়া তো আর কিছু থাকে না। তাঁহাদের অস্তিত্ব সে ক্ষেত্রে মূল্যহীন হইয়া পড়ে। মন্ত্রিপদে কাজ করিবার দক্ষতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। ইহাতে সরকারের মুখচ্ছবি উজ্জ্বল হইতে পারে না। বস্তুত প্রদীপের নীচে আঁধারের ন্যায় ‘দিদিকে বলো’ তেমনই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিকে মেলিয়া ধরিতেছে। সকলেই মানেন, এই কর্মসূচি তৃণমূল দ্বারা নিযুক্ত ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরের মস্তিষ্কপ্রসূত। লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলের ধাক্কা খাওয়ার পরে মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়া এই পদক্ষেপ। কিন্তু দিদিকে না বলিলে কোনও সমস্যাই মিটিবে না, এই বার্তা যে ভাবে চোরা স্রোতের ন্যায় প্রবাহিত হইতেছে, তাহাতে ‘দিদি’র গৌরব বাড়িলেও তাঁহার সরকারের গৌরব বিশেষ বাড়ে না। যদিও অন্যতর নির্মম সত্যটি হইল, মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উৎস অনুসন্ধান করিতে থাকিলে কেষ্ট-বিষ্টুদের অনেকের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হইবার ঝুঁকি ষোলো আনা। অতএব বিকল্প একটিই। যাহা বলিবার, সব শুধুই ‘দিদিকে বলো’! তিনিই পারের কর্ত্রী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy