Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
কিসে লাভ কিসে আরও লাভ

ভারতীয় রাজনীতিতে এখন মায়াবতীই সব চেয়ে বড় রহস্য

সহজ সরল বিশ্লেষণে মনে হয় মোদীবিরোধী জোটেই মায়াবতীর লাভ। সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নিজেদের আসন বাড়াতে পারলে তিনি ভারতের প্রথম ‘দলিত’ প্রধানমন্ত্রীও তো হতে পারেন। যে ভাবে কুমারস্বামী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।

মায়াবতী

মায়াবতী

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

নরেন্দ্রপুরের মাস্টারমশাই অজিতদা বলেছিলেন, সারা জীবন একটা কথা মনে রাখিস, তুই আসলে জানিস খুবই কম। সবজান্তা ভাবটা হল, ‘আমি কী হনু রে সিনড্রোম’। নবীন সাংবাদিক ছিলাম যখন, তখনও অনেক সময় ভ্রম হত, আমি বুঝি জানি। পাঠকেরা বলতেন, ‘‘আসল ব্যাপারটা কী বলুন তো? আপনারা তো সাংবাদিক, ভেতরকার ব্যাপার সব জানেন।’’ এর পর রুজ়ভেল্টের আত্মকথা পড়লাম। হোয়াইট হাউসে যা হচ্ছে, তার কতটুকু জানি? বয়স যতই বাড়ছে, মনে হচ্ছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্টই যদি এমন বলেন, তবে আমি কোথায়?

৮২ বছর বয়সের পাঠক ইনল্যান্ড লেটারে প্রশ্ন তুলেছেন, মায়াবতী কী করবেন? বিজেপির দিকে? না কি রাহুল-অখিলেশ জোটে? মনে হল, মায়াবতীর সম্ভাব্য রাজনীতি নিয়েই এ বার কথা বলি। ২০১৯-এর ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে ওই ৬২ বছর বয়সি নেত্রীর উপর। বিগত লোকসভা নির্বাচনে তিনি উত্তরপ্রদেশ থেকে একটাও আসন পাননি। অথচ ভোটব্যাঙ্কের হিসেবে তাঁর দল ছিল তৃতীয়। শুধু তো উত্তরপ্রদেশ নয়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ও ছত্তীসগঢ়ের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বহুজন সমাজ পার্টি বহু আসনে প্রার্থী দিয়ে পৃথক লড়লে বিজেপির লাভ। আর কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে দ্বিপাক্ষিক লড়াই হলে লাভ কংগ্রেসের।

সহজ সরল বিশ্লেষণে মনে হয় মোদীবিরোধী জোটেই মায়াবতীর লাভ। সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নিজেদের আসন বাড়াতে পারলে তিনি ভারতের প্রথম ‘দলিত’ প্রধানমন্ত্রীও তো হতে পারেন। যে ভাবে কুমারস্বামী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। অখিলেশের সঙ্গে মায়া দর-কষাকষি করে বেশি আসন চাইছেন, যাতে তাঁর আসনসংখ্যা মমতার ৪২টির চেয়ে বেশি হয়। প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে মায়ার প্রতিদ্বন্দ্বী মমতা। তবু আমি টেবিল ঠুকে ‘আমি কী হনু রে’ সাংবাদিক হতে চাইছি না। কেন জানেন? এক প্রয়াত প্রবীণ সাংবাদিক বলেছিলেন ‘‘রাজনৈতিক বিশ্লেষণ অতীতে ঠিক হত, আজকাল হয় না কেন জানো? আগে রাজনীতির লাভ-লোকসানের হিসাবেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। তখনও ভারতের রাজনীতিতে অমর সিংহ আসেননি। এখন বিশ্লেষণ ভুল হয়ে যায় কারণ নেপথ্যে কাজ করে টাকার খেলা।’’ তার ওপর আছে দুর্নীতির মামলা। সিবিআই বা সিআইডি-র মায়াজাল। ১৯৯৫ সালে মায়াবতী প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন। মুলায়মকে ক্ষমতাচ্যুত করে সমাজবাদী পার্টিকে বিচ্ছিন্ন করতে মায়াবতীকে কংগ্রেসও সমর্থন জানায়। কিন্তু কল্যাণ সিংহের আপত্তি সত্ত্বেও আডবাণীর মনে হয়েছিল, মায়াবতীকে সমর্থন করলে বিজেপির লাভ। প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের ঐতিহাসিক মন্তব্য, ‘‘মায়াবতীর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ভারতীয় রাজনীতির অলৌকিকতা।’’

ঘটনা হল, অম্বেডকর তাঁর সৃষ্ট রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টি অব ইন্ডিয়াকে শুধু মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায়ের দল করতে চাননি, চেয়েছিলেন এই দলটির রাজনৈতিক ভিত্তি আরও প্রসারিত হোক। সেটা হয়নি। কাঁসিরাম ১৯৮৪ সালে বহুজন সমাজ পার্টির জন্ম দিয়ে ভোটে নেমে প্রথম আওয়াজ তুললেন দলিতদের জন্য। তার আগে এটা ছিল একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, একটা ছাতার মতো, তারই ভিতর ছিল পিছড়ে বর্গ, তফসিলি জাতি, দলিত ও সংখ্যালঘুরা। রাজনৈতিক দল গড়ে পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশে কাঁসিরাম প্রাথমিক ভাবে ‘দলিত’দের লক্ষ্য করে এগোন। দ্রুত দলিত আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। সেই সময় লখনউতে দুটো স্লোগান দারুণ জনপ্রিয় হয়। একটা হল, “তিলক, তরাজু অউর তলওয়ার, ইসকো মারো জুতে চার।” তিলক মানে ব্রাহ্মণ, তরাজু মানে বৈশ্য, আর তরোয়াল মানেই ক্ষত্রিয়। শুরু হল মনুবাদীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ। আর একটা স্লোগান ছিল, “ভোট হমারা রাজ তুমহারা, নহি চলেগা নহি চলেগা।”

১৯৯৯ সালে মায়াবতী কৌশল বদলান। তিনি বলেন, বহুজন সমাজ মানে তো সকলের সমাজ। তাই উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রচুর প্রার্থী দিয়ে তিনি বাজিমাত করেন। মুসলমানদেরও ছাতার তলায় আনার চেষ্টা করেন। সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে বহুজন সমাজ পার্টি সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় কাঁসিরাম বলেন, ‘‘ওরা আমাদের কাছ থেকে ওবিসি ভোটটাও নিয়ে নিচ্ছিল।’’ ১৯৯৩-এ বিজেপিকে রুখতে মুলায়মকে সঙ্গে নেন। আবার ’৯৫-এ মুলায়মকে ছেড়ে বিজেপিকে সঙ্গী করেন। ভারতীয় রাজনীতিতে মায়াবতীর বহুরূপী চরিত্র বরাবরই।

ইতিহাস থাক। এখন কী হচ্ছে? এখন অখিলেশ-মায়া-রাহুল একজোট। মধ্যপ্রদেশে কমলনাথও জোট করতে মরিয়া বিধানসভা ভোটে। এ দিকে অমিত শাহ মায়াবতীর ব্রাহ্মণ নেতা সতীশ মিশ্রর মাধ্যমে মায়াবতীকে সঙ্গে পেতে চাইছেন। প্রথম টোপ, মায়াবতীর বিরুদ্ধে চলতে থাকা সমস্ত তদন্ত শেষ করে দেওয়া হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাব, মায়াবতীর ভাইয়ের বিরুদ্ধেও চলা মামলা প্রত্যাহার। তৃতীয়ত, মায়াবতী সব রাজ্যে স্বাধীন ভাবে প্রার্থী দিলে বিজেপি তাঁকে সাহায্য করবে। চতুর্থত, দলিত স্বার্থে বড় ঘোষণা, যেমন, কাঁসিরামকে ভারতরত্ন প্রদান ইত্যাদি। আর সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে মায়াবতীকে চাপে রাখা? উত্তরপ্রদেশের নবীন প্রজন্মের দলিত নেতা চন্দ্রশেখরকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে বিজেপি কী বার্তা দিতে চায়? মায়াবতী চেয়েছিলেন, চন্দ্রশেখর জেলেই থাকুন। এখন চন্দ্রশেখর তাঁকে ‘বুয়া’ ডাকলেও মায়াবতী বলছেন, ওর সঙ্গে কোনও আত্মীয়তা নেই। চন্দ্রশেখর বলছেন ‘‘আমার তো রাজনৈতিক দল নেই, ভোটে লড়ব না। সমর্থন করব এসপি–বিএসপি জোটকে।’’ মায়াবতী বলছেন, ‘‘এ ধরনের গুন্ডাগরদি করা লোককে সমর্থন করতে পারি না। আসলে চন্দ্রশেখর বিজেপিরই বি-টিম।’’

বুঝুন ঠেলা! যদি চন্দ্রশেখর নির্দল প্রার্থী দেন তাতেও তো বহুজন সমাজ পার্টি তথা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ জোটেরই বিপদ। তাই রাহুল-অখিলেশ সর্ব শক্তি দিয়ে মায়াবতীকে জোটে রাখতে আগ্রহী। বিজেপি যদি মায়ার কানে কানে এসে বলে, দরকারে সংখ্যা না থাকলে আপনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী? অখিলেশও তো কানে কানে সে কথাই বলছেন মায়াকে? আপাতত তাই দড়ি টানাটানি।

ভারতীয় রাজনীতিতে মায়াবতী মানেই অনিশ্চয়তা। মায়াবতী উত্তরপ্রদেশে নানা দলের সমর্থনে চার বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কাঁসিরাম তাঁকে বলে গিয়েছেন, জোট তখনই করবে, যেখানে তুমি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবে। এক বার তো নিজের মুখ্যমন্ত্রী পদের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই সমর্থন প্রত্যাহার করে বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙে দেন। ফলে সে বার কল্যাণ সিংহ মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। যদিও সেটাই ছিল বোঝাপড়া। প্রথম দলিত মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি হন লৌহমানবী। আজ, ৬২ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে মায়াবতী কি আরও ক্লান্ত? রাজনৈতিক লড়াইয়ের অতীত আগুন নিভু-নিভু, এখন কি তাই আপস? রাজনৈতিক দর কষাকষি?

দর কষাকষির খেলায় মায়া চিরকালই সিদ্ধহস্ত। এই ভয়ও তিনি অখিলেশ আর রাহুলকে দেখিয়ে রেখেছেন যে, মনের মতো আসন না পেলে তিনি ‘একলা চলো রে’ নীতি নেবেন। তাতে তো লাভ হবে বিজেপির। রাহুল তাই অখিলেশকে বলছেন, যত আসন মায়া চাইছেন, দিয়ে দাও। ওঁকে ছাড়লেই লোকসান। মোদীকে সরানো অখিলেশের অগ্রাধিকার ঠিকই। কিন্তু অখিলেশের ভয়, এত আসন দিয়ে দিলে তাঁর দল যদি বিদ্রোহে ভেঙে যায়!

প্রয়াত অজিতদার সতর্কবাণী ভুলছি না। সহজ সরল সত্য বলছি, ভারতীয় রাজনীতিতে আজ সব চেয়ে বড় রহস্য মায়াবতী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE