মায়াবতী কী ভাবিতেছেন? ভারতীয় রাজনীতিতে বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যতের কঠিনতম প্রশ্ন বোধ করি ইহাই। আপাতত উত্তরের অভাবে মায়াবতী কী করিবেন না তাহা ভাবিয়াই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সিদ্ধান্ত টানার চেষ্টা করিতেছেন। যেমন, আগে জানা ছিল, ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেস ও বিজেপি সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবে। ক্রমশ উপলব্ধ হইল, মায়াবতী তাহা হইতে দিবেন না। তিনি আলাদা শক্তি হিসাবে, কিংবা অজিত যোগীর জেসিসি-র শরিক হিসাবে, নির্বাচনে অবতীর্ণ হইবেন, ভোটকে দ্বিমেরু হইতে দিবেন না। মায়াবতীর এই চালে কংগ্রেস বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হইল, না বিজেপি, সে বিতর্ক এখনও চলিতেছে। বিএসপি যেমন কংগ্রেসের ভোট অনেকাংশে কাটিয়া লইতে পারে, তেমনই বিজেপির ঝুলি হইতেও দলিত ভোট বাহির করিয়া লইতে পারে। তাই, মায়াবতী কাহারও সরাসরি সহায়ক হইবেন না, এটুকু স্পষ্ট হইলেও শেষ পর্যন্ত তাঁহার পরিকল্পনাটি কী, তাহা অস্পষ্টই থাকিল। মধ্যপ্রদেশের ক্ষেত্রে, দলিত ভোটের ভাগাভাগিতে বিজেপির বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা। আবার উত্তরপ্রদেশে, বিজেপি-বিরোধীদেরই মায়াবতীকে লইয়া দুশ্চিন্তা বেশি। সে রাজ্যে দলিত এবং ওবিসি বা অন্যান্য পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর মধ্যে অনিঃশেষ মারামারি-কাটাকাটির কারণে সমাজবাদী পার্টি-বহুজন সমাজ পার্টির দীর্ঘমেয়াদি মিলনের সম্ভাবনাটি রীতিমতো ক্ষীণ। সব মিলাইয়া, বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে ও আগামী জাতীয় নির্বাচনে, সর্বাপেক্ষা জটিল প্রহেলিকা মায়াবতী কাহার দিকে হেলিতেছেন, কতখানি দুলিতেছেন, তাহাই হয়তো ভারতাকাশের ভাগ্যনির্ণয়ের চাবিকাঠি হইবে।
এবং সম্ভবত, ইহাই মায়াবতীর পরিকল্পনা— ‘চাবিকাঠি’ হওয়া। আসনসংখ্যা হুহু করিয়া বাড়িবে, এই আশা তেমন উজ্জ্বল নহে, হয়তো তিনি তাহা উজ্জ্বল করিবার কাজে শক্তিক্ষয় করিতে চাহেনও না। তিনি চাহেন, বিভিন্ন রাজ্যে ভোট শতাংশ অধিক মাত্রায় বাড়াইয়া বড় দলগুলির কাছে সরকার গড়িবার চাবিকাঠি হিসাবে নিজেেক প্রতিষ্ঠা করিতে। প্রসঙ্গত, তাঁহার নিজের রাজ্য উত্তরপ্রদেশেও আসনসংখ্যা অনেকটা বাড়িবার আশা নাই। সুতরাং বিকল্প পরিকল্পনাটিই তাঁহার কাছে সর্বোত্তম ঠেকিবার কথা। এ বিষয়ে নিজের রাজনৈতিক গুরুর সুযোগ্য শিষ্যা তিনি। কাঁসিরাম বলিয়াছিলেন, ‘মজবুত সরকার’ নহে, ‘মজবুর সরকার’ চাই— শক্তপোক্ত সরকারে তাঁহার দলের কী স্বার্থ, বরং এমন সরকারই আসুক, যাহার কাছে তাঁহার দলের সহায়তা আবশ্যিক হইবে। তাই, প্রথমে নিজেকে আবশ্যিক করিয়া তোলা, তাহার পর ক্রমে নিজে কেন্দ্রীয় চরিত্র হইতে চেষ্টা করা: মায়াবতীর মাথাতেও এখন এই হিসাবই চলিতেছে বলিয়া অনুমান।
অতঃপর একটিই কথা থাকিয়া যায়। মায়াবতী যদি অধরা থাকেন, তবে প্রস্তাবিত ‘মহাগঠবন্ধন’-এর অবস্থা কী দাঁড়াইবে? বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের ‘কুডাক’ই কি সত্য হইবে? মহাগঠবন্ধন কেবল কল্পলোকের বস্তু থাকিয়া যাইবে? কংগ্রেস ক্রমশ এ বিষয়ে হাল ছাড়িয়া দিতেছে, ইঙ্গিতে পরিষ্কার। রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের ভোটের আগে বিএসপি-র হালচাল দেখিয়া কংগ্রেস এমনও ভাবিতেছে যে, বিজেপি সিবিআই ভীতিকেও মায়াবতীর ক্ষেত্রে কাজে লাগাইতেছে। পদ্ধতি যাহাই হউক, ফলের দিক হইতে বিজেপি-বিরোধী জোট যে মায়াবতীর অনুপস্থিতিতে অনেকটাই দুর্বল হইবে, নিশ্চিত। কিন্তু ‘চাবিকাঠি’ হইতেই যিনি বেশি আগ্রহী, তাঁহার ক্ষেত্রে কি সম্পূর্ণ হাল ছাড়িয়া দেওয়াও যায়? প্রশ্ন তবে ইহাই, দরদামের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত নেত্রী কী দাম হাঁকিবেন। সব মিলাইয়া, রাজনীতির প্রান্তে পর্যবসিত হইয়াও কী ভাবে আবার মূলস্রোতের চাবিকাঠি হইয়া উঠিতে হয়, দেখাইয়া দিলেন মায়াবতী। এই ভাবেও ফিরিয়া আসা যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy