বস্টন গ্লোব পত্রিকায় ট্রাম্প বিরোধী সম্পাদকীয়। ফাইল চিত্র
ষোলোই অগস্ট, ২০১৮। সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসে দিনটি দাগ দিয়া গেল। ওই দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে তিনশোরও অধিক সংবাদপত্র বৃহস্পতিবার একটিই বিষয় লইয়া সম্পাদকীয় স্তম্ভে লিখিল। সেই বিষয়, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বাঁচাইবার প্রয়োজন, এবং তাহার জন্য জনসাধারণের সমর্থনের আবেদন। এমন অভূতপূর্ব ঐক্যের কারণটি অবশ্যই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাঁহার বিষোদ্গারের সম্মুখে সাংবাদিকরা বিপন্ন বোধ করিতেছেন। বিরূপ সমালোচনা করিলেই ট্রাম্প সাংবাদিককে ‘বিরোধী’ ও সংবাদকে ‘ভুয়া’ বলিয়া ঘোষণা করিতেছেন। ট্রাম্পের দুর্নীতি বা ভ্রান্ত নীতি লইয়া প্রশ্ন তুলিলে সংবাদমাধ্যমকে ‘গণশত্রু’ বলিতেছেন। এই লাগাতার আক্রমণের বিরুদ্ধে এই বার জোট বাঁধিয়াছে সংবাদপত্রগুলি। একটি পত্রিকা তাহার সম্পাদকীয়তে এক প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের একটি কথা মনে করাইয়াছে। দেশে সংবাদপত্র না থাকিয়া সরকার থাকিবে, না সরকার না থাকিয়া সংবাদপত্র থাকিবে, তাহা নির্ণয় করিতে হইলে দ্বিতীয়টিই তিনি বাছিয়া লইবেন, বলিয়াছিলেন জেফারসন। আজ সেই প্রেসিডেন্টও নাই, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নাই। এতগুলি সংবাদপত্রের এমন অবস্থান সে দেশের গণতন্ত্রকে কতটা শক্ত করিল বলা কঠিন। কিন্তু বিশ্ববাসীর নিকট এমন বৃহৎ প্রতিবাদ কিছু বিস্ময়কর লাগিতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অধিক সুরক্ষিত। মার্কিন সংবিধানই (ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট) নির্দিষ্ট ভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করিয়াছে। ভারত-সহ নানা দেশে সংবিধান বা আইন এ বিষয়ে অত স্পষ্ট নহে। সেখানে বাক্স্বাধীনতার সুরক্ষার আশ্বাসকে টানিয়া সংবাদপত্রের স্বতন্ত্রতা খুঁজিতে হয়।
বিভিন্ন দেশেই সাংবাদিকের স্বাধীনতা বিপন্ন। তুরস্কে দুই শতাধিক সাংবাদিককে কারাবন্দি করিয়াছে সরকার। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলির পূর্বে প্রায় সরাসরি সংবাদমাধ্যমগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে। সাংবাদিকদের অপহরণ, দমনপীড়ন সে দেশে নিত্য ঘটনা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা সর্বজনবিদিত। ভারতের দশা তথৈবচ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ অবধি একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করেন নাই। তাঁহার কার্যকালে সাংবাদিক হত্যা, ভীতিপ্রদর্শন বাড়িয়াছে, মানহানির মামলা পূর্বের সকল দৃষ্টান্ত ছাড়াইয়াছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনও প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনার ‘অপরাধ’-এ সাংবাদিকদের উপর এমন গুরুতর আঘাত আসে নাই। তৎসত্ত্বেও সংবাদপত্রগুলি একজোট হইয়া সম্মিলিত আক্রমণ করিয়াছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। এই প্রবল প্রতিক্রিয়ার কারণ কী?
হয়তো মার্কিন সাংবাদিকরা বুঝিয়াছেন, বিষবৃক্ষে জলসেচন করিলে ফলের আবির্ভাব হইবেই। তাহার আগাম ইঙ্গিতও মিলিয়াছে। একটি জনমত সমীক্ষায় এক-তৃতীয়াংশ লোক সহমত যে, ‘সংবাদমাধ্যম গণশত্রু’। কোনও সংবাদমাধ্যম ‘মন্দ ব্যবহার’ করিলে তাহাকে বন্ধ করিয়া দিবার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের থাকা দরকার, এমন মত সমর্থন করিয়াছে চার জনে এক জন। ট্রাম্পের সভাগুলিতে সমবেত জনতা সাংবাদিকদের প্রতি কটূক্তি করিতেছে। গণপ্রহার কেবল সময়ের অপেক্ষা, এমনই আশঙ্কা সাংবাদিকদের। সংবাদ তথা গণতন্ত্রের বিপন্নতা রুখিতে তাই জোট বাঁধিয়াছেন সাংবাদিকরা। কিন্তু জনসমর্থনের জন্য এমন ‘সম্মিলিত আবেদন’ অস্বস্তিও জাগাইয়াছে। ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ বলিয়াছে, রাষ্ট্রনায়কের সমালোচনার অধিকার সাংবাদিককে যে আইন দিয়াছে, সংবাদপত্রকে সমালোচনা করিবার অধিকারও রাষ্ট্রনায়ককে দিয়াছে সেই আইন। সংবাদপত্রগুলির একযোগে প্রতিবাদ হয়তো ট্রাম্প-বিরোধিতাকে আরও তীব্র করিতে পারে। কিন্তু বিরোধিতার সেই পথটি রাজনৈতিক। মিডিয়ার পথ ইহা নয়। বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের বিরোধিতা করিতে জনসমর্থনের জন্য বিরোধীরাই আবেদন করিয়া থাকে। তাই ট্রাম্পের ‘বিরোধী’ তকমা হয়তো আরও চাপিয়া বসিবে মিডিয়ার উপর। সর্বোপরি, সংবাদমাধ্যম একযোগে কোনও ব্যক্তিকে ‘খলনায়ক’ সাব্যস্ত করিলে তাহার সম্পর্কে নিরপেক্ষ সংবাদ পাইবার আশা কতটুকু? কঠিন প্রশ্ন। সংবাদের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে নিয়ত সংগ্রাম প্রয়োজন, তাহা স্পষ্ট। কিন্তু লড়াইয়ের উপায় তাহার লক্ষ্যকে বিপন্ন করিলে সংগ্রামই বৃথা হইবে। গণতন্ত্রের পথ এমনই কঠিন।
অনেক বিখ্যাত মানুষ দু’চার দিনের মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি মারা গেলে মুশকিল। এক জনকে নিয়ে অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাসের নৈবেদ্য সাজিয়ে ‘উনি আমাকে নিজ হাতে শিঙাড়া খাইয়েছিলেন’ ফেঁদে বসতে না বসতে আর এক জনের সভায় ‘নিজ মুখে গাল দিয়েছিলেন’ বক্তিমের সময় উপস্থিত। নয়পলের কটকটে ব্যবহারের গল্প কাটাকুটি হয়ে যাচ্ছে, বাজপেয়ীর নেতৃত্বের চোটে ওয়াড়েকরের অধিনায়কত্ব পিছনের পাতায় ঠেলা খাচ্ছে। নিয়তির কি কোনও টাইমিং-এর জ্ঞান নেই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy