Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Medical College

শুধু প্রয়োজন নয়, অধিকার

মাথার ওপর ছাদ না থাকা অবস্থায়, ভবঘুরে জীবনযাপন করে যে কোনও উচ্চশিক্ষাই সম্পন্ন করা মুশকিল, আর ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করা তো প্রায় অসম্ভব।

প্রতিবাদ।

প্রতিবাদ।

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

মেডিক্যাল কলেজের আন্দোলনকে ঘিরে অনেকগুলো প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলছেন, এই দাবিগুলো সঙ্গত, সকলের জন্য হস্টেলের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা দরকার, কিন্তু এই দাবিতে অনশন একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? এ প্রশ্ন শুনে আমার সাহিবের কথা মনে এল।

সাহিবুদ্দিন (নাম পরিবর্তিত) আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু। মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আশির দশকের শেষের দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পড়তে এসেছিল। কৃষক পরিবারের সন্তান, বেশ কষ্ট করেই গ্রাসাচ্ছাদন চলত কলকাতায়। প্রায়শই মুড়ি চিবোনো ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ক্যান্টিনের রাখালদা যে দিন মাতৃস্নেহে দু’টি ডাল-ভাত আগলে বসে থাকতেন, সে দিন হয়তো একবেলা ভাত জুটত। কলকাতায় সাহিবের কোনও কাকা, মামা, দাদা ছিলেন না। ফলে একটি হস্টেল তার বিশেষ দরকার ছিল। তদানীন্তন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলগুলির মধ্যে কোনও এক অলিখিত নিয়মে মুসলমান ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ ছিল কারমাইকেল হস্টেল। সাহিব যখন কলকাতায় এল, কারমাইকেলের সব আসন পূর্ণ। সাহিবের পকেটে পয়সা নেই যে মেস ভাড়া করে থাকবে। অনেক খুঁজে নারকেলডাঙায় এক মাংসের দোকানে তার আশ্রয় জুটল। রাতে দোকান বন্ধ করে দোকানি বাড়ি চলে যেতেন, তখন দোকানের নীচের ঘরে থাকত সাহিব। স্নাতকোত্তরের দু’বছর তার ভাগ্যে কারমাইকেলের শিকে ছেঁড়েনি। রোজ রাতে পাখাহীন ঘরে, টিমটিমে আলোয় পড়াশোনা করত সাহিব। তার পর একগাল মুড়ি চিবিয়ে চট পেতে ঘুমোত।

মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র আন্দোলনের জয়ের খবর পেয়ে আমার লজ্জা করল। সাহিবের হস্টেলের দাবিতে আমরা সে দিন অনশনে কেন বসিনি— ভেবে অপরাধবোধে মাথা নত হয়ে এল। আজও কোচবিহার কিংবা বাঁকুড়া থেকে আসা ছাত্রটির হয়তো সাহিবের দশা। আমরা যারা যে শহরে থাকি সেই শহরেই পড়াশোনার ভাগ্য করে জন্মেছি, তারা এই যন্ত্রণা বুঝব না বোধ হয়। মাথার ওপর ছাদ না থাকা অবস্থায়, ভবঘুরে জীবনযাপন করে যে কোনও উচ্চশিক্ষাই সম্পন্ন করা মুশকিল, আর ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করা তো প্রায় অসম্ভব।

প্রশ্ন হল, যে দেশের ‘উন্নয়ন’-এর গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী, যে রাজ্যে উন্নয়ন ‘পথে দাঁড়িয়ে থাকে’, সেখানে ছাত্ররা পড়াশোনার ন্যূনতম সুবিধাটুকু পাবে না কেন? উচ্চশিক্ষার জন্য জেলা থেকে যে ছাত্রছাত্রীদের শহরে আসতে হয়, কেন তাদের জন্য যথাযথ ছাত্রাবাস থাকবে না? কেন ছাত্রসংখ্যার অনুপাতে ছাত্রাবাসের পরিকল্পনা সরকার নিজে থেকেই করবে না? ছাত্রাবাসের গুণগত মানের খেয়ালই বা কেন রাখবে না? কেন ইঁদুর, কুকুরের অত্যাচারে ছাত্রাবাস ছেড়ে পালাতে হবে ছাত্রদের? কেন মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে রাত কাটাতে হবে? যে রাজ্যে সরকার পাড়ার ক্লাবকে যখন তখন লাখ লাখ টাকা অনুদান দেয়, বিরোধী দলের প্যান্ডেল ভেঙে পড়ার কারণে আহত মানুষকে লাখ টাকা দান করে, দেশি মদ খেয়ে মৃতদের পরিবারকেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, সেই সরকার ছাত্রদের, ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের, পড়াশোনার পরিবেশ সুনিশ্চিত করার জন্য খরচ করবে না কেন?

এ তো শুধু ছাত্রদের প্রয়োজনের কথা নয়, এ হল অধিকারের প্রশ্ন। দেশের সব ছেলেমেয়েকে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, শিক্ষার পরিবেশ দেওয়া, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাষ্ট্রের কাজ জেলায় জেলায় উন্নত মানের মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, যাতে বাড়ির ভাত খেয়ে ছাত্ররা শান্তিতে পড়াশোনা করতে পারে। সেটা না পারলেও, অন্ততপক্ষে জেলার ছাত্রদের জন্য শহরে থেকে পড়াশোনার ব্যবস্থা তো সরকারকে করতেই হবে।

মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে একটি সমালোচনা কানে এল। এ নাকি রাজনৈতিক আন্দোলন। প্রশ্ন হল, কোনও আন্দোলনই কি কখনও অরাজনৈতিক হয়? সিভিল সোসাইটি অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দ্বারা পরিচালিত আন্দোলন মানেই তা অরাজনৈতিক, এ ধারণা অত্যন্ত ভ্রান্ত। সাধারণ মানুষের আন্দোলনেও রাজনীতি থাকে বইকি! সে রাজনীতি ক্ষমতার মাতব্বরিকে চ্যালেঞ্জ করে, ক্ষমতার দম্ভকে চূর্ণ করে। সে রাজনীতি আমরা পশ্চিমবঙ্গে নন্দীগ্রাম-পরবর্তী সময়ে দেখেছি। এমন উদাহরণ আরও অনেক আছে।

মেডিক্যাল কলেজের আন্দোলনকে রাজনৈতিক বলার পিছনে আর একটি কারণ হল, অনেকের ধারণা এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দলের গণসংগঠন হিসেবে কাজ করে এমন ছাত্র সংগঠনগুলির হাত আছে। হতে পারে। তর্কের খাতিরে ধরেই নেওয়া গেল, আছে। কিন্তু সে কারণে তো তাদের দাবিগুলোকে বাতিল করা যায় না। সকলের জন্য ছাত্রাবাস, স্বচ্ছ পদ্ধতি মেনে ছাত্রাবাসের আবেদন মঞ্জুর করার দাবি তো অন্যায্য নয়। আর রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় ছাত্র সংগঠন করাও কোনও অপরাধ বা অসাংবিধানিক কাজ নয়। যদি সরকারে থাকার সুবাদে কোনও রাজনৈতিক দল ক্ষমতার অপব্যবহার করে, ছাত্রদের ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত করে, তা হলে তো বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনগুলি প্রতিবাদ করবেই। গণতন্ত্র তো সে ভাবেই বহমান থাকে।

রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় ছাত্র রাজনীতি পরিচালিত হওয়া ঠিক নয় বলেই মনে করি। দল যদি ছাত্র সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা হলে তা ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে অবশ্যই হানিকর। ছাত্র আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা, সৃষ্টিশীলতা তার ফলে বিঘ্নিত হয়। কিন্তু ছাত্ররা রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় তাদের আন্দোলন চালাবে কি না সেটা তো ছাত্রদেরই ঠিক করতে হবে। তারা রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের অঙ্গুলিহেলনে চলবে, না কি নিজেদের ওপর ভরসা রাখবে— সেটা তাদেরই চয়েস।

মেডিক্যাল কলেজের এই আন্দোলনকে সরকার কী চোখে দেখল, সেটাও বিশ্লেষণের প্রয়োজন। ছাত্রছাত্রীরা যখন না খেয়ে কলেজের বারান্দায় শুয়ে আছে, তখন সরকার থেকে এমন ভাব করা হচ্ছে যেন কোথাও কিছু ঘটছে না। অবশেষে ২২ জুলাই প্রতিষ্ঠান (ডিএমই) থেকে প্রেস বিবৃতি যখন দেওয়াও হল, সেখানে বলা হল, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার অঙ্গ, স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষতি হচ্ছে, তাই ছাত্রদের ‘প্রতীকী’ অনশন তুলে নেওয়া উচিত। অর্থাৎ ছাত্রদের দাবিগুলো কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়, এতগুলো ছেলেমেয়ে খালি পেটে দশ-বারো দিন ধর্না দিচ্ছে, সে-ও কোনও বড় ব্যাপার নয়, সরকারের স্বাস্থ্য পরিষেবার বদনামের জন্যই তাঁরা চিন্তিত!

মেডিক্যাল কলেজ দেখিয়ে দিল, মানুষ যদি সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে সঙ্গত দাবির ভিত্তিতে কোনও আন্দোলন চালায়, তা হলে তা সফল হয়। এই আন্দোলন অবশ্যই রাজনৈতিক আন্দোলন, কিন্তু রাজনৈতিক মুনাফা তোলা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। সেখানেই এই আন্দোলনের সার্থকতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE