Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

তাণ্ডব

দুই বৎসর অতিক্রান্ত, তবু ডিমনিটাইজেশনের স্মৃতি টাটকা। অরুণ জেটলির মনেও। যদিও তাঁহার পরম শত্রুও দাবি করিবে না যে নোটবাতিল করিবার কুনাট্যে তাঁহার বিন্দুমাত্র ভূমিকা ছিল, তবু, তখনও তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন, এখনও আছেন

অরুণ জেটলি।

অরুণ জেটলি।

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ঝাঁকানিটি যে মোক্ষম হইয়াছিল, অরুণ জেটলি না বলিলেও ভারত তাহা হাড়ে হাড়ে জানে। তাহার এমনই প্রাবল্য যে শিল্পক্ষেত্র এক দিকে ছিটকাইয়া পড়িল, অসংগঠিত ক্ষেত্রের নাভিশ্বাস উঠিল, সাধারণ মানুষ সূর্যোদয় হইতে সূর্যাস্ত অবধি এক এটিএম হইতে অন্য এটিএম-এ লাইন লাগাইলেন, এবং দিনের শেষে একটি দুই হাজার টাকার নোট পকেটে পুরিয়া বাড়ি ফিরিলেন, যাহাকে খুচরা করা আর এক অভিযান। দুই বৎসর অতিক্রান্ত, তবু ডিমনিটাইজেশনের স্মৃতি টাটকা। অরুণ জেটলির মনেও। যদিও তাঁহার পরম শত্রুও দাবি করিবে না যে নোটবাতিল করিবার কুনাট্যে তাঁহার বিন্দুমাত্র ভূমিকা ছিল, তবু, তখনও তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন, এখনও আছেন। তখন বেজার মুখে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। এখন ব্লগ লিখিয়া নোটবাতিলের সমর্থনে যুক্তি দিয়াছেন: ভারতীয় অর্থনীতিকে এই ঝাঁকানি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কেন? কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদ, কাশ্মীরে উগ্রপন্থীদের ভাতে মারিবার পরিকল্পনা, নকল টাকা রুখিবার প্রতিজ্ঞা— ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদী কথিত লক্ষ্যগুলির একটিরও উল্লেখ করেন নাই অর্থমন্ত্রী। জানাইয়াছেন, কালো টাকার মালিকদের কর মিটাইতে বাধ্য করাই ছিল লক্ষ্য। করদাতার সংখ্যা বাড়িয়াছে। সুতরাং ডিমনিটাইজেশন সফল।
অর্থশাস্ত্রে অরুণ জেটলির ব্যুৎপত্তি পূর্বসূরিদের অধিকাংশের সঙ্গেই তুলনীয় নহে বটে, কিন্তু এই আইন-বিশারদ নিজের যুক্তির সারহীনতা নিজে নিশ্চয়ই জানেন। আয়করদাতার সংখ্যা বাড়িয়াছে বটে, কিন্তু পরিসংখ্যান বলিতেছে, অধিকাংশের আয়ই করযোগ্য আয়ের সীমার ধারেকাছে। জেটলি বলিতে পারেন, গত দুই অর্থবর্ষে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ যথাক্রমে ১৪.৬% ও ১৭.১% বাড়িয়াছে। ২০১০-১১ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে আয়কর আদায়ের পরিমাণ বাড়িয়াছিল যথাক্রমে ১৮ ও ১৪.৩%। কোনও ঝাঁকানি ছাড়াই। কাজেই, কালো টাকার মালিকদের আয়কর দিতে বাধ্য করিবার যুক্তিটি নিতান্তই ফাঁপা। অবশ্য, জেটলি নাচার। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক জানাইয়া দিয়াছে, বাতিল হওয়া নোটের ৯৯.৩ শতাংশই ব্যাঙ্কে ফিরিয়া আসিয়াছে। নকল নোটও বাজার দাপাইতেছে, কাশ্মীরও অশান্ত। বলিবার মতো কীই বা আর জেটলির হাতে আছে? অতএব, আয়করের খড়কুটা।
দুই বৎসরের দূরত্বে দাঁড়াইয়া নির্দ্বিধায় বলা চলে, নোটবাতিল নামক তাণ্ডবটি সম্পূর্ণ অনর্থক ছিল। জেটলি বলিতে চেষ্টা করিয়াছেন, গোটা দুনিয়ায় বৃহৎ অর্থনীতিগুলির মধ্যে ভারতেরই বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ। চিনের আর্থিক বৃদ্ধির হার কমিয়াছে, তাহার জন্য যদি নরেন্দ্র মোদীকে কৃতিত্ব দিতে হয়, তবে ভিন্ন কথা— নচেৎ, দীর্ঘকাল ধরিয়াই ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার দুনিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল। প্রশ্ন: নোটবাতিল না ঘটাইলে কি ভারতীয় অর্থনীতি আরও দ্রুত বাড়িত না? যাবতীয় ক্ষেত্র বলিতেছে, বাড়িত। তাহারও অধিক গুরুত্বপূর্ণ, নোটবাতিলের ধাক্কাটি দরিদ্র শ্রেণির মানুষের উপর প্রবলতর হইয়াছে। সেই ক্ষতির পূরণ হইবে কোন মন্ত্রে? অরুণ জেটলির নিকট এই প্রশ্নগুলির উত্তর আশা করা অর্থহীন। কারণ, নোটবাতিলের পিছনে যে অর্থনীতির যুক্তি ছিল না, ছিল কেবল এক জন রাজনীতিকের বিসদৃশ আত্মম্ভরিতা, তাহা স্বীকার করা জেটলির পক্ষে অসম্ভব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Economy Arun Jaitley Banking Demonetisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE