Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ন্যূনতম আয়, একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা

অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষের হাতে জাতীয় সম্পদের মাত্র ০.২ শতাংশ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির অভিমুখ সর্বজনীন আয়ের দিকে থাকলে দেশের ও দশের মঙ্গলই হবে বলে আশা করা যায়। লিখছেন ভাস্কর গোস্বামী প্রকল্প রূপায়ণের আগে দেখে নেওয়া যাক ন্যূনতম আয়ের ভিত্তি ও তার উৎস।

সুদিনের অপেক্ষায়। —ফাইল ছবি।

সুদিনের অপেক্ষায়। —ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৬:১২
Share: Save:

কয়েক মাস আগে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সভাপতি রাহুল গাঁধী একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন, ন্যূনতম আয় যোজনা। কয়েক দিন আগে বিষয়টি পরিষ্কার করে রাহুল গাঁধী জানান, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে কুড়ি শতাংশ দরিদ্র ভারতবাসীদের বাৎসরিক ৭২ হাজার টাকা ন্যূনতম আয়ের ব্যবস্থা করা হবে। নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী ঘোষণা। এই ঘোষণার পর থেকে ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে ন্যূনতম আয়ের সুরক্ষা প্রকল্প। প্রায় প্রতিটি নতুন প্রকল্প ঘোষণার মধ্যে থাকে বিতর্কের অবকাশ। এ ক্ষেত্রেও যা প্রযোজ্য। আসলে নতুন প্রকল্প ঘোষণার মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে এক সন্দেহের বাতাবরণ। কী সেই সন্দেহ? অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই এই সন্দেহের উৎপত্তি। কারণ, অতীতেও ক্ষমতায় আসার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, যে সবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা হবে। আর এই টাকাটি আসবে কালো ধন উদ্ধারের মাধ্যমে। আরও অনেক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মতো (যেমন বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থান, স্কিল ইন্ডিয়া, ইত্যাদি) আমরা জানি যে, মোদীর এই ঘোষণাটি এখনও মরীচিকা হয়ে থেকে গিয়েছে। তাই নূন্যতম আয়ের ঘোষণাটি শুধু একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে থাকবে, নাকি, কার্যকর হবে, সন্দেহ সেখানেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ন্যূনতম আয় প্রকল্পের বাস্তব রূপায়ণের অনেক বাধা বিপত্তি আছে, ও থাকবে। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন ওঠে। প্রকল্প রূপায়ণের আগে দেখে নেওয়া যাক ন্যূনতম আয়ের ভিত্তি ও তার উৎস।

সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের ধারণাটি খুবই প্রাচীন। এর প্রথম উল্লেখ আমরা পাই ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে থমাস ম্যুরের ইউটোপিয়া বইটির মধ্যে। সেখানে বলা আছে, রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব, নাগরিকদের সুরক্ষা ও আয় নিশ্চিত করা। এটাই পরে ইথিওপিয়ান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু ও লক্ষ্য হয়ে ওঠে। শোনা যায়, সেই সময় চোরেদের ফাঁসির আদেশ না দিয়ে তাদের ন্যূনতম আয়ের ব্যবস্থা করা ভাল এমন দাবিও উঠেছিল। যাতে তারা সমাজের মূলস্রোতে ফিরে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এই ধারণাটির পেছনে যে দর্শন ছিল, তা হলো মূলত খাদ্য ও বস্ত্রের অভাবে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষেরা চুরি করেন। আর তার এই অভাব ঘোচানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে ন্যূনতম আয় বন্টণের মাধ্যমে।

পরে পৃথিবীর নানা জায়গায়, বিভিন্ন সময়ে, এই সর্বজনীন ন্যূনতম আয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু, পরে অর্থনীতির অন্যান্য বিষয়ের চর্চার মধ্যে চাপা পড়ে যায় ন্যূনতম আয়ের ধারণাটি। ষাটের দশকে শেষে আবার অর্থনীতির মূলস্রোতে নতুন ভাবে ফিরে আসে সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের প্রসঙ্গ। বিভিন্ন আঙ্গিকে ন্যূনতম আয় প্রকল্পটির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অনেকে, সর্বজনীন ন্যূনতম আয় না বলে ঋণাত্মক কর ব্যবস্থা অর্থাৎ নেগেটিভ ইনকাম ট্যাক্স বলেন। বলা হয়, প্রত্যেক নাগরিকের দেশের মোট সম্পদে সমান ভাগ থাকা উচিত। দেশের সম্পদের সমান ভাগীদার হওয়ার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। এর থেকে উৎপত্তি হয় সর্বজনীন আয়ের ধারণাটি। আশির দশকের শেষের দিকে এই সর্বজনীন আয়ের ধারণাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর জন্য অনেকটাই দায়ী আধুনিক যুগের পুঁজিবাদের সঙ্কট। বিশ্বব্যাপী পুঁজির গঠন খুব উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তন হয়েছে। পুঁজির গঠনের এই মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে, মূলত তিনটি চালিকা শক্তির মাধ্যমে— তথ্যপ্রযুক্তি, টেলি-কমিউনিকেশন ও পরিবহণ। ফলে, পুঁজির এই তিনটি চালিকাশক্তির দখল যে সব বড় সংস্থাগুলির হাতে, তারা অনায়াসে ছোট ও ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে প্রতিযোগিতার বাজারে কোণঠাসা করে দিচ্ছে। এরই সঙ্গে কর্মসংস্থানের বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তন হচ্ছে। এখনকার যুগে তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিকমিউনিকেশন ও পরিবহণের ক্ষেত্রে যে উচ্চআয়ের কর্মসংস্থান হচ্ছে সেটা সীমাবদ্ধ থাকছে কিছু মানুষের মধ্যে। অন্য দিকে, গতানুগতিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের মজুরি খুব একটা বাড়েনি। ফলে আয়ের অসামঞ্জস্য বেড়েছে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এখন সমাজ ও অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদের বিপুল অসাম্য লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশে এই অসাম্য এতটাই প্রবল যে, সমীক্ষায় দেখা যায় মোট জাতীয় সম্পদের প্রায় সত্তর শতাংশ মালিকানা ধনী কর্পোরেটের হস্তগত। অন্য দিকে, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষের হাতে জাতীয় সম্পদের মাত্র ০.২ শতাংশ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির অভিমুখ সর্বজনীন আয়ের দিকে থাকলে দেশের ও দশের মঙ্গল হবে বলে আশা করা যায়।

এ বার আসা যাক এই সর্বজনীন ন্যূনতম আয় প্রকল্পের বাস্তবিক রূপায়ণের দিকটি। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে ওই দরিদ্র কুড়ি শতাংশের মাপকাঠি কী হবে? দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারীরাই কি এই প্রকল্পের উপভোক্তা? সেটাই যদি হয়, তা হলে এই প্রকল্পটি দারিদ্র্য দূরীকরণের আর একটি উন্নয়নমুখী প্রকল্প। কিন্তু সেটা সর্বজনীন নয়। একই সঙ্গে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করার মূল সমস্যা হচ্ছে, ওই কুড়ি শতাংশ দরিদ্র পরিবারকে চিহ্নিত করা। এই দেশে তথ্যের ভাণ্ডার খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। আবার বহু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তথ্য বিকৃত করার উদাহরণও রয়েছে। যার ফলে অনেক আসল উপভোক্তা, এই প্রকল্পের আওতার বাইরে পড়ে থাকার আশঙ্কা থেকে যায়।

হিসেব কষে দেখা যায় যে, এই ন্যূনতম আয় যোজনা বাস্তবায়িত করতে খরচ পড়বে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকা। যা বর্তমান জাতীয় আয়ের দুই শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ টাকা কোথা থেকে আসবে, তা এখনও অনিশ্চিত। অনেকেই মনে করেন, এই জাতীয় ন্যূনতম আয় প্রকল্পের রূপায়ণের ফলে অন্যান্য যে সব উন্নয়নমুখী প্রকল্প ভর্তুকির সাহায্যে চলে, সেগুলি কাটছাঁট করা হবে বা পুরোপুরি তুলে নেওয়া হবে। এই সন্দেহ খুব একটা অমূলক নয়। কারণ, তুলে দেওয়া ভর্তুকি-যুক্ত প্রকল্পগুলি থেকে যে টাকা সাশ্রয় হবে, তা দিয়ে এই ন্যূনতম আয় প্রকল্পটি চালানো সম্ভব। ফলে তুলে নেওয়া হতে পারে একশো দিনের কাজ, রান্নার গ্যাস, পেট্রোল ও ডিজেলের উপরে ভর্তুকি। উঠে যেতে পারে কৃষিক্ষেত্রে সার ও বীজের উপরে ভর্তুকি। স্বাস্থ্য প্রকল্পের ভর্তুকি উঠে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। কিন্তু, এই ভর্তুকি যুক্ত প্রকল্পগুলি তুলে নেওয়া কখনই কাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ, তাতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ও অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। ঘোষিত ন্যূনতম আয় দিয়েও এই সব পরিষেবা ও জিনিসগুলি মিলবে না। ফলে ন্যূনতম আয়ের আশু উদ্দেশ্যটি অঙ্কুরে নষ্ট হবে। এ সত্ত্বেও বলা যায়, বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে ভর্তুকি না তুললেও এই ন্যূনতম আয় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করা যায়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এ দেশে বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মুকুবের নজির আছে। নজির আছে, বহুজাতিক সংস্থাগুলির রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ঋণ খেলাপের ঘটনা। ঋণ খেলাপ করে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন, এমন বেশ কয়েকটি উদাহরণ চোখের সামনে রয়েছে। সেখানে এই প্রান্তিক, দরিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্য টাকার সংস্থান কখনই প্রকল্পটির রূপায়ণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। প্রকল্পটি রূপায়ণের টাকার উৎস হতে পারে বহুজাতিক সংস্থার উপরে মূলধনী কর বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের উপরে কর আরোপ।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Income Congress Poverty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE