Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
চাইলে নরেন্দ্র মোদীও রাজনীতির ধূলিঝড় থামাতে পারতেন

আচার্য বনাম প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইস্তক চার বছরে মোদী বিশ্বভারতীতে আসার সময় করে উঠতে পারেননি। পারলেন এখন।

এক সঙ্গে: বিশ্বভারতীর পড়ুয়াদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনে আচার্য রাজীব গাঁধী। শান্তিনিকেতন, ১৯৮৭

এক সঙ্গে: বিশ্বভারতীর পড়ুয়াদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনে আচার্য রাজীব গাঁধী। শান্তিনিকেতন, ১৯৮৭

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৮ ০০:২৭
Share: Save:

বিশ্বভারতীর সমাবর্তন ঘিরে এ বার যা যা ঘটেছে, তা ইতিমধ্যেই বহুচর্চিত। এ সব না ঘটলেই যে ভাল হত, সে কথা আশ্রমিক থেকে শুরু করে বাইরেরও অনেকেই একবাক্যে বলছেন। কেউ মানতে চান বা না-চান, এটা ঘটনা যে, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে আজও একটা ভিন্নতর সমীহ কাজ করে। সেখানকার আবহাওয়া অন্য পাঁচ জায়গার থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা হবে, এমনটাই লোকের বিশ্বাস। তাই দিনকাল যতই বদলাক, মূল্যবোধের অবক্ষয় যতই স্পষ্ট হোক, বাজারের আর পাঁচটি শিক্ষাক্ষেত্রের মতো কলরব অন্তত আম্রকুঞ্জের সমাবর্তন-অঙ্গনে পৌঁছবে না, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। সেই আশায় ছাই পড়েছে। সৌজন্যে, আচার্য নরেন্দ্র মোদীর প্রথম সফর।

প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইস্তক চার বছরে মোদী বিশ্বভারতীতে আসার সময় করে উঠতে পারেননি। পারলেন এখন। যার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর একান্ত বৈঠকও। লক্ষ্য এবং উপলক্ষ দাঁড়িপাল্লার দু’দিকে চাপিয়ে দেওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে বিশ্বভারতীর আচার্য নরেন্দ্র মোদী যে সে দিন হেরে ভূত হয়ে গিয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ তাঁর সময়াভাবের যুক্তিতে সমাবর্তনের অনেক কিছুই ছেঁটে ফেলতে হয়েছিল। এমনকী উত্তীর্ণদের হাতে সপ্তপর্ণী তুলে দেওয়ার মূল পর্বটিও শোচনীয় ভাবে বাদ হয়ে যায়।

পরিবর্তে যা পাওয়া যায়, তা হল সমাবর্তন স্থলে ‘মোদী, মোদী’ ধ্বনি, ‘জয় শ্রীরাম’ নিনাদ, সিটি বাজানো ইত্যাদি। আচার্য নন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী সে সব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন। তাঁকে হাত তুলে স্লোগানকারীদের প্রত্যুত্তর দিতেও দেখা গিয়েছে।

বিশ্বভারতীর সমাবর্তনস্থলে কারা মোদী এবং শ্রীরামের জন্য গলা ফাটাতে এসেছিলেন, জানা নেই। তবে সভা আলো করে রাজ্য বিজেপির একঝাঁক নেতা মঞ্চের সামনের বাঁ দিকে বসার জায়গা পেয়েছিলেন, সবাই দেখেছেন। যত দূর জানা আছে, বিশ্বভারতীর তরফে ওই নেতাদের নামে নির্দিষ্ট ভাবে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়নি। তার প্রশ্নও ছিল না। তবে শেষ মুহূর্তে দিল্লি থেকে কিছু কার্ড চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেগুলি কোথায় কার হাতে পৌঁছেছিল তা অবশ্য বলা কঠিন। কিন্তু সমাবর্তনের অনুষ্ঠানে এই রকম ঘটনা অনেক রহস্যময় প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে দেয়!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে যে ভদ্রলোক বিশ্বভারতী তৈরি করেছিলেন, তাঁর নিজের অবশ্য কিছু স্বপ্ন ও ভাবনা ছিল। সেখান থেকে বিচ্যুতি তাঁকে ব্যথিত করত। তিনি সেগুলি নানা ভাবে বলেও দিয়ে গিয়েছেন। মণিমাণিক্যের মতো তা ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন লেখায়। বিশেষত তাঁর একাধিক চিঠিপত্রে।

কী চেয়েছিলেন কবি? শান্তিনিকেতনকে তিনি ‘রাজনীতির ধূলিঝড় থেকে রক্ষা’ করার কথা বলেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, শান্তিনিকেতন রাজনীতি করার জায়গা নয়। রাজনীতি করা ভুল না হলেও শান্তিনিকেতনে আশ্রমের ছন্দের সঙ্গে রাজনীতির তাল মেলে না— এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের অভিমত।

হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস) থেকে ১৯২০ সালের ৩ অক্টোবর একটি চিঠিতে বন্ধু সি এফ অ্যান্ড্রুজ়কে সেই কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন: Santiniketan must be saved from the whirlwind of dusty politics. ঠিক এক মাস পরে নভেম্বরের ৪ তারিখে নিউ ইয়র্ক থেকে আবার অ্যান্ড্রুজ়কেই তিনি লিখেছেন: Keep Santiniketan away from the turmoils of politics... We must not forget that our mission is not politics... Where I have my politics, I do not belong to Santiniketan. বলেছেন: I do not mean to say that there is anything wrong in politics, but only that it is out of harmony with our Asram.

হল কই? রাজনীতি শান্তিনিকেতনের বুকে ক্ষয়রোগের মতো বাসা বেঁধেছে কয়েক দশক। বিভিন্ন কারণে তার প্রতিফলনও হরদম দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই রাজনীতির রং আচার্যের চেয়ারে লাগেনি। এ বার লাগল।

আগাম প্রস্তুতি সত্ত্বেও এ বার ‘দেশিকোত্তম’ প্রদান স্থগিত করে দেওয়ার পিছনেও হয়তো সেটাই আসল কারণ। না-হয় ধরে নিচ্ছি, কয়েকশো উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীর হাতে সপ্তপর্ণী তুলে দেওয়ার মতো ‘সময়’ আচার্য-প্রধানমন্ত্রীর ছিল না। কিন্তু পাঁচ-সাত জনকে ‘দেশিকোত্তম’ প্রদান করতে কত ক্ষণ ব্যয় হত তাঁর?

আসলে বিষয়টা তো নিছক সময়াভাব নয়। সবাই বোঝেন, যে রাজনীতির জন্য সমাবর্তন-অঙ্গনে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানকে মোদী হাত তুলে উৎসাহ জুগিয়েছেন, সেই রাজনীতিই তাঁকে বুঝিয়েছে, দেশিকোত্তম-এর সুপারিশ তালিকায় যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের ‘হৃদয়-পদ্ম’ যথেষ্ট প্রস্ফুটিত নয়! অতএব, দেশিকোত্তম তালিকা আপাতত আটকে গেল।

কেন প্রধানমন্ত্রীর মতো রাজনীতির লোককে আচার্য করা হবে, তা নিয়ে বিশ্বভারতীতে প্রশ্ন উঠেছে বার বার। আজও ওঠে। কিন্তু স্মরণকালের মধ্যে, একমাত্র উমাশঙ্কর জোশীর ব্যতিক্রম ছাড়া, এর কোনও অন্যথা দেখা যায়নি। পদাধিকারে নরেন্দ্র মোদী যে তালিকায় বর্তমান।

অনেকেরই ধারণা, আর্থিক বা অন্যান্য সুযোগসুবিধার পথ প্রশস্ত করতেই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতীতে প্রধানমন্ত্রীদের আচার্য করার একটি পরম্পরা চালু হয়ে গিয়েছে। ফলে সহজবোধ্য কারণেই দিল্লির ক্ষমতাসীন দল শান্তিনিকেতনের আশ্রম পরিমণ্ডলে নিজেদের অস্তিত্ব ও প্রাধান্য জাহির করার তাড়না অনুভব করে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষও নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের তোয়াজ করে থাকে। সরকারের রং বদলালেও এই মূল বন্দোবস্ত বদলায় না। অতীতে ইন্দিরা বা রাজীব গাঁধী যখন আচার্য হয়ে এসেছেন, তখনও তাই কংগ্রেসের চেনামুখ নেতাদের সমাবর্তনস্থলে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যেটা ভাবাচ্ছে, সেটা হল, সমাবর্তন-মঞ্চ থেকে রাজনীতিকে কতটা প্রশ্রয় জোগানো হবে? স্বয়ং আচার্য-প্রধানমন্ত্রী যদি সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে দলীয় নেতার মতো আচরণ করেন এবং দলের শামিয়ানায় মানানসই স্লোগানকে আম্রকুঞ্জের সমাবর্তন সভায় ‘স্বাগত’ জানাতে থাকেন, তা হলে তাঁকে সেই মুহূর্তে আচার্য বলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। এবং বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনকে রাজনীতির ধূলিঝড় থেকে ‘বাঁচানোর’ কোনও সদিচ্ছাই হয়তো তাঁর মানসিকতায় কাজ করে না।

যদি করত, তা হলে সমাবর্তনস্থলে রাজনৈতিক স্লোগানের এমন নির্লজ্জ উদ্‌গিরণের বিরুদ্ধে মুখ খুলে তিনি স্লোগানকারীদের সংযত হওয়ার উপদেশ দিতে পারতেন। বক্তৃতায় বলতে পারতেন, এখানে এ সব করা অশোভন এবং ঐতিহ্যের পরিপন্থী। দুর্ভাগ্য, তিনি তা বলেননি। তাঁর ওই মৌনকে সম্মতির লক্ষণ ভাবলে তাই খুব ভুল হবে কি?

মনে পড়ে, ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে যখন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী আচার্য হিসাবে শান্তিনিকেতনে যান, সে বার এক চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল, যার হোতা ছিল রাজ্যের তৎকালীন শাসক সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই। সমাবর্তনের আগের সন্ধ্যায় পূর্বা়ঞ্চলীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রবেশপত্র না-পাওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে অশান্তির সূত্রপাত। পাল্টা নেমে পড়ে কংগ্রেসের সংগঠন ছাত্র পরিষদ। পুলিশ লাঠি চালায়। অনেক ছাত্রছাত্রী আহত হন। গোলমাল তীব্র আকার নেয়। এমনকী পর দিন সকালে সমাবর্তন শান্তিতে হবে কি না, তা নিয়েও উদ্বেগ বাড়ে।

রাজীব সন্ধ্যার অনুষ্ঠান সেরে উত্তরায়ণে পৌঁছতেই গেটে বিক্ষোভ আছড়ে পড়ল। তিনি কী করলেন? দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর জামা খুলে আচার্য হয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন একেবারে বিক্ষোভরত পড়ুয়াদের মাঝখানে। নিরাপত্তারক্ষীদের ধমকে সরিয়ে দিলেন এবং আন্দোলনকারীদের ভিড়ের মধ্যে গিয়ে তাঁদের বললেন, ‘‘কী হয়েছে? আমাকে বলো। আমি শুনব তোমাদের সব কথা।’’ এর পরে ওই রাতেই নিরাপত্তা ছাড়া একটি অ্যাম্বাসাডরে উঠে আচার্য রাজীব সোজা চলে যান পড়ুয়াদের হস্টেলগুলিতে। শোনেন তাঁদের থাকা-খাওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ। রাজনীতির মেঘ কেটে আন্দোলনের মুখ ঘুরে যায় আস্থায়। আচার্যের কাছে সব বলতে পেরে ভারমুক্ত ছাত্রছাত্রীরা পর দিন ঐতিহ্য মেনে যোগ দেন সমাবর্তনে।

পরে সাংবাদিকদের রাজীব বলেছিলেন, ‘‘রাজনীতির নামে সমাবর্তনের অঙ্গন যদি কলুষিত হয়, সেটা রবীন্দ্রনাথের আদর্শের অপমান। আচার্য হিসাবে আমি সেটুকু রক্ষা করার চেষ্টা করেছি।’’

পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। তবে তিন দশক পরে আর এক আচার্য-প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা কিন্তু সমাবর্তনের মঞ্চে রাজনীতির কলুষকেই কার্যত মান্যতা দিয়ে গেল।

‘অচ্ছে দিন’ দেখল শান্তিনিকেতন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rajiv Gandhi Visva-Bharati Narendra Modi Students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE