প্রধানমন্ত্রীর দুই দিনের চিন সফরটিকে কি সফল বলা চলে? কঠিন প্রশ্ন। সাংহাই কোঅপারেশন অরগানাইজ়েশন বা এসসিও-র বৈঠকে গিয়া নরেন্দ্র মোদী অনেকগুলি দলিলে স্বাক্ষর করিয়াছেন, চিনের সহিত সহযোগিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন, এত বড় একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে অংশগ্রহণ করিয়া তাহার সাফল্য আনিতে সাহায্য করিয়াছেন। এই সকলই আশাপ্রদ। পাকিস্তান ও ভারতকে একত্রে এক মঞ্চে আনা সহজ কথা নয়। পাকিস্তান ও ভারত যুগপৎ কোনও ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করিতেছে, ইহাও অহরহ ঘটে না। তদুপরি সেই ঘোষণাপত্রটি আবার সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত, একই সঙ্গে তাহাতে দিল্লি ও ইসলামাবাদের সিলমোহর পড়িতেছে। এমন দুর্লভ ঘটনা শেষ অবধি ঘটিল। আশা অহেতুক নহে। অবশ্য এই ঘটনা ঘটাইবার কৃতিত্বটি প্রধানত চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংয়ের প্রাপ্য। তবুও নরেন্দ্র মোদীর জন্য ধন্যবাদবার্তা থাকিয়া যায়। তাঁহার সরকার যে অন্তত এইটুকু সদর্থক মনোভাব দেখাইতে পারিয়াছে, সন্ত্রাসবাদ লইয়া পাকিস্তানের সহিত হাত মিলাইব না বলিয়া অকারণ হইচই বাধায় নাই, সে জন্যই এই ধন্যবাদ প্রাপ্য। নূতন পাক প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেনের সহিত মোদীর করমর্দন লইয়া প্রচারমাধ্যম ইতিমধ্যে অনেক কথা বলিয়া ফেলিয়াছে। অধিক কথা ও অধিক আশাবাদে না গিয়া বরং এইটুকু বলাই শ্রেয় যে, পূর্বের বেশ কয়েকটি বৈঠকের অভিজ্ঞতা যে এ বার ঘটিল না— ইহা সুখের কথা। মোদী যে তাঁহার দৃঢ়বদ্ধ মুখমণ্ডলের রেখায় রেখায় তীব্র কঠিনতা না ফুটাইয়া স্বাভাবিক ভাবে পাক প্রেসিডেন্টের সহিত করমর্দন করিলেন, তাহা ভারত-পাক পর্বের ঐতিহাসিক মাইলফলক না হইতে পারে, কিন্তু স্বস্তিদায়ক ভদ্রতার দৃষ্টান্ত হইয়া থাকিল। এই সুবিবেচনা ভবিষ্যতেও অক্ষুণ্ণ থাকিবে কি?
সব সুখপুষ্পেই কণ্টক থাকে। কিনদাওতেও রহিল। চিনের বহু-বিজ্ঞাপিত বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআইআর) প্রস্তাবে সব দেশ স্বাক্ষর করিলেও ভারত করিল না। ভারত এ বিষয়ে আগেই আপত্তি দর্শাইয়াছিল, ফলে তাহার অসহযোগিতাকে অপ্রত্যাশিত বলা যাইবে না। বরং আলাদা করিয়া এই বৈঠকের সদর্থক মনোভাবের উল্লেখ করিতে হইবে, কেননা একমাত্র ভারতই যে হেতু আপত্তি তুলিয়াছে, ভারতের নাম ছাড়াই অন্যান্য দেশের সই-সংবলিত প্রস্তাবটি অনুমোদিত হইল। অন্য নথিগুলি স্বাক্ষরের সময় যে ভাষা ব্যবহার হইতেছিল, তাহা হইতে আলাদা খসড়াপত্র তৈরি হইল বিআইআর প্রস্তাবটির জন্য। সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত। এসসিও-র মতো বড় মাপের আন্তর্জাতিক বৈঠককে সচল রাখিতে হইলে এই নমনীয়তা জরুরি। সব বিষয়ে সব দেশের মতামত এক না হইতেই পারে। বিতর্কের পথটি খোলা রাখিলে সংঘর্ষের পরিমাণ কমিতে পারে।
কেন ভারত এই প্রয়াসের বিরোধিতা করিতেছে, অজানা নহে। ভারতের সার্বভৌমত্ব ইহাতে খাটো করা হইয়াছে, অভিযোগ ইহাই। মুশকিল হইল, মোদী নিজেই যখন বলিতেছেন নূতন বৈদ্যুতিন যুগে পারস্পরিক যোগাযোগ ভূগোলের সংজ্ঞাটি বদলাইয়া দিতেছে, তখন ভূগোলকে আঁকড়াইয়া সার্বভৌমত্বের যুক্তি দিলে কি ভারতেরই পিছাইয়া পড়িবার সম্ভাবনা নয়? ‘এক-পথ’ দিয়া যখন চিন হইতে পাকিস্তান, কাজাকস্তান, কিরঘিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, রাশিয়া পর্যন্ত একটি বাণিজ্য সহযোগিতা বলয় তৈরি হইবে, ভারত তাহার বাহিরে থাকিলে কি ভারতেরই ক্ষতি নয়? জাতীয় সার্বভৌমত্বের দাবিটি গুরুতর, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রাপ্তির বিষয়টিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আশা রহিল, এসসিও-র পরবর্তী বৈঠকসমূহে ক্রমে এই যুক্তি-জট খুলিবে। জাতীয় স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের সমন্বয় তৈরি হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy