Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
টাকার কথা মনে পড়লেই আপনি আত্মবিশ্বাসী হবেন, স্বার্থপরও

মন নিয়ে খেলা চলবেই

‘‘হাতে টাকা এলে ও রকম হয়’’, বলল সূর্য। ‘‘এর জন্যই তো আমি বড়লোক হওয়ার চেষ্টাই করলাম না।’’

সঙ্কট: ‘নায়ক’ সিনেমার একটি দৃশ্যে উত্তমকুমার

সঙ্কট: ‘নায়ক’ সিনেমার একটি দৃশ্যে উত্তমকুমার

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০১:১৬
Share: Save:

বিপ্লবের সঙ্গে দেখা হল, বুঝলি।’’ একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল তপেশ। ‘‘বোলচাল পাল্টে গিয়েছে পুরো। শিশিরের প্যাকেট থেকে সিগারেট খেয়ে গোটা জীবন কাটাল, আর আজ কী সব লম্বাচওড়া বাতেলা। গাড়িতে ছেড়ে দিল এই অবধি। ঢুকতে বললাম, ব্যাটা মিটিং দেখিয়ে কাটিয়ে দিল।’’

‘‘হাতে টাকা এলে ও রকম হয়’’, বলল সূর্য। ‘‘এর জন্যই তো আমি বড়লোক হওয়ার চেষ্টাই করলাম না।’’

‘‘হাতে না এলেও হয়, সূর্য, মাথায় এলেই যথেষ্ট।’’ চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন শিবুদা। ‘‘টাকাপয়সা সংক্রান্ত একটা লেখা পড়লে, বা টাকার ছবির সামনে বসে থাকলেও মানুষ পাল্টে যায়। আমি বলছি না, গবেষণা বলছে।’’

‘‘কী রকম?’’ প্রশ্ন করে তপেশ।

‘‘বলছি, কিন্তু তার আগে বল দিকি, এই যে সূর্য বলল হাতে টাকা এলে মানুষ পাল্টে যায়, সেই পাল্টানোটা কী রকম?’’ পাল্টা প্রশ্ন করেন শিবুদা। তার পর নিজেই বললেন, ‘‘শোন। সব পাল্টানোই যে খারাপের দিকে, তা তো নয়। টাকা থাকলে মানুষ অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়, যে কোনও কাজে সফল হওয়ার জন্য অনেক বেশি চেষ্টা করে। আবার, স্বার্থপরও হয়। অন্যকে আর সাহায্য করতে চায় না, সামাজিক ভাবে খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখতে চায়। টাকা থাকা আর না থাকায় মানুষের আচরণ, মনোভাব কী রকম ভাবে পাল্টায়, তা নিয়ে দিস্তে দিস্তে গবেষণা হয়েছে। কিন্তু, আমি বলছি একটা অন্য কথা— ধর, তোর পকেটে বা ব্যাঙ্কে টাকার পরিমাণ বিন্দুমাত্র পাল্টালো না, কিন্তু আমি খানিক ঘুরপথে তোকে টাকার কথা মনে করিয়ে দিলাম, শুধু সেটুকুতেই কি তোর আচরণ পাল্টে যাবে?’’

‘‘প্রশ্নটাই তো বুঝলাম না’’, উত্তর দেয় সূর্য। ‘‘আপনি কি জানতে চাইছেন যে হাতে টাকার পরিমাণ না বাড়লেও, শুধু টাকার কথা মনে করিয়ে দিলেই আমি একই সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী আর স্বার্থপর হয়ে উঠব কি না?’’

‘‘একদম তাই’’, উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘হবি?’’

তপেশরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। শিবুদা একটা সিগারেট ধরান। তার পর বলেন, ‘‘প্রশ্নটারই মানে বুঝতে পারছিস না তো? হাতে টাকা বাড়ল না, অথচ মনটা পাল্টে গেল— এ রকম আবার হয় না কি? গত দশকের গোড়ার দিকে তিন মনোবিজ্ঞানী ক্যাথলিন ভোস, নিকোল মিড আর মিরান্ডা গুড এই পরীক্ষাটাই করেছিলেন। একটা দুটো নয়, পর পর ন’টা এক্সপেরিমেন্ট। কোথাও কোনও নগদ টাকা নেই, কিন্তু টাকার প্রসঙ্গ আছে। একটা এক্সপেরিমেন্টে পার্টিসিপ্যান্টদের একাংশকে পড়তে দেওয়া হয় এমন কিছু বাক্য, যাতে টাকা সংক্রান্ত শব্দ রয়েছে। অন্যদের পড়তে দেওয়া হল তেমন শব্দহীন বাক্য। তার পর, দু’দলকেই এমন পরিস্থিতিতে ফেলা হল, যেখানে তাদের অন্য কাউকে সাহায্য করতে হবে। দেখা গেল, যারা একটু আগেই টাকা সংক্রান্ত শব্দগুলো পড়েছে, তারা সাহায্য করছে অনেক কম।

‘‘আবার, অন্য একটা এক্সপেরিমেন্টে দু’দলের হাতে তুলে দেওয়া হল দু’ধরনের লেখা— ভিডিয়ো ক্যামেরার সামনে তা পড়তে হবে। লেখাগুলো, বুঝতেই পারছিস, দু’রকম। একটা লেখার বিষয়বস্তু ছিল অর্থের প্রাচুর্য, অন্যটার বিষয় অর্থের অভাব। পড়া হয়ে গেলে দু’দলকেই একটা কাজ দেওয়া হল। কঠিন কাজ, কিন্তু অসম্ভব নয়। দেখা গেল, যারা অর্থের প্রাচুর্য সংক্রান্ত লেখাটা পড়েছে, তারা অনেক বেশি চেষ্টা করছে কাজটা করতে। ভেবে দেখ— দু’দলের লোকের মধ্যে লেখাটা ছাড়া আর তো কোনও ফারাক নেই, একেবারেই র‌্যান্ডম স্যাম্পল হিসেবে দল ভাগ করা হয়েছিল— অথচ, শুধু টাকার প্রাচুর্যের কথা পড়েই তাদের আত্মবিশ্বাসে, চেষ্টায় কতখানি পার্থক্য হয়ে গেল।’’

‘‘বলছেন বটে, কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না ঠিক’’, খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে প্রথম কথা বলে শিশির। ‘‘শুধু টাকার কথা মনে পড়িয়ে দেওয়াতেই এতখানি পাল্টে যায় আচরণ, এটা হতে পারে?’’

‘‘বার্ধক্যের কথা মনে পড়িয়ে দেয়, শুধু এ রকম কিছু শব্দ পড়লে একেবারে তরুণরাও স্বাভাবিকের তুলনায় আস্তে হাঁটে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে বেশি সময় নেয়, এ কথাটা বিশ্বাস হবে তোর?’’ প্রশ্ন করেন শিবুদা। ‘‘কিন্তু, বিশ্বাস না করে উপায় নেই, শিশির। ফোনটা বার করে এক বার গুগ্‌ল সার্চ কর ‘ফ্লরিডা এফেক্ট’। ১৯৯০-এর দশকের সব চেয়ে বেশি আলোচিত এক্সপেরিমেন্টগুলোর একটা ছিল নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির জন বার্গ-এর এই পরীক্ষাটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন তাঁরা। স্বভাবতই, তারা সবাই তরুণ। পাঁচটা শব্দের অনেকগুলো সেট দিয়ে বলেছিলেন, চার শব্দের বাক্য তৈরি করতে হবে প্রতিটা সেট থেকে। এক দল ছাত্রের সেটে ছিল বার্ধক্য সংক্রান্ত শব্দ— ভুলো মন, টাক, পাকা চুল, রিঙ্কল-এর মতো শব্দ, আর ফ্লরিডা। জানিস তো, আমেরিকায় লোকে বুড়ো বয়েসে ফ্লরিডায় বাড়ি কিনতে চায়? অন্য দলের সেটে এই শব্দগুলো ছিল না। দেখা গেল, বার্ধক্য সংক্রান্ত শব্দগুলো যারা পড়েছে, এক্সপেরিমেন্টের পর তারা অন্যদের তুলনায় আস্তে হাঁটছে। বিশ্বাস করবি না, জানি, কিন্তু আমি যদি একটা কাগজে হাসপাতাল, ব্লাড টেস্ট, হার্ট অ্যাটাক, নার্স, বৃদ্ধাশ্রমের মতো অনেকগুলো শব্দ লিখে তোকে পড়তে দিই, তার পর বলি যে পাশের টেবিল থেকে জলের বোতলটা এনে দে, অন্য দিনের তুলনায় আজ তুই একটু আস্তে হাঁটবি।’’

‘‘এ তো সাংঘাতিক কথা বলছেন মশাই! মন নিয়ে খেলা আর কাকে বলে!’’ শিবুদা থামতেই মন্তব্য গুঁজে দেয় তপেশ।

‘‘এত দিনে একটা বুদ্ধিমানের মতো কথা বললি’’, তপেশের পিঠ চাপড়ে দেন শিবুদা। ‘‘তবে, মন নিয়ে খেলা নয়, বুঝলি, মনই আমাদের নিয়ে খেলছে। খুব সহজ করে বললে, আমাদের মনের মধ্যে প্রতিটা চেনা শব্দের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে হরেক অনুষঙ্গ। ধর, হঠাৎ যদি আমি বলি জেনচা, তোর কিছুই মনে হবে না। কিন্তু, ‘পরীক্ষা’ শব্দটা শুনলেই প্রশ্নপত্র, ঘড়ি, হল, না পারার টেনশন— হরেক কথা মনে পড়ে যাবে। তোর শরীরেরও মনে পড়বে, ব্লাড প্রেশার একটু বাড়বে, হাতের রোম সামান্য খাড়া হবে, হার্টবিট দ্রুততর হবে। আর পুরোটাই হবে এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে, এবং পুরোটাই করবে তোর অবচেতন মন। এই যে একটা শব্দ, অথবা একটা ছবি, একটা সুর এক পলকের মধ্যে তোর শরীর-মনকে পাল্টে দিতে পারে, একেই বলে প্রাইমিং।

‘‘গত বছর, রিচার্ড থেলার যখন নোবেল পেলেন, কৌশিক বসুর একটা কথা পড়েছিলাম কাগজে। বলেছিলেন, বিপণনের দুনিয়া বহু দিন ধরেই মানুষের মনকে নিয়ে খেলে চলেছে। প্রাইমিং তার একটা মোক্ষম উদাহরণ। যে কোনও শপিংমলে ঢোক, দেখবি চমৎকার গান বেজে চলেছে একটানা। মোটেই তোর মন ভাল করে দেওয়ার জন্য নয়। বরং, সেই গানগুলোর সঙ্গে ভাল সময় কাটানোর যে স্মৃতি তোর মনের মধ্যে আছে, সেটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। তোর মন বুঝতে পারবে না, যে ভাল লাগার বোধটা হচ্ছে, সেটা দোকানের জিনিসপত্র দেখে, না কি নেহাত গানটার জন্য। যে হেতু গানটা নিছকই পিছনে বেজে চলেছে, খুব সম্ভবত তোর মন বোকা বনবে। ভাববে, জিনিসগুলো দেখেই ভাল লাগছে। ফলে, বিক্রিও বাড়বে।

‘‘আরও উদাহরণ আছে। কারও কোনও একটা কথা শোনার সময় যদি তুই সমানে ওপর নীচে মাথা ঝাঁকাতে থাকিস, মানে যে ভাবে হ্যাঁ বলিস, সে ভাবে, তা হলে সেই কথাটার সঙ্গে একমত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। আর যদি ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়িস, তবে যে কথাটা শুনছিস, তার সঙ্গে একমত হবি না, সেই সম্ভাবনা বেশি। আবার, হাসিমুখে কোনও কথা শুনলে সেটার সঙ্গে সহমত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। মোদ্দা কথাটা হল, তোর অজান্তেই মনকে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে প্রাইমিং।’’

‘‘বুঝুন! তার মানে, গোটা দুনিয়া আমার মন নিয়ে খেলবে, আর আমি হাত গুটিয়ে বসে দেখব?’’ প্রশ্ন করে তপেশ।

‘‘উঁহু, তুইও খেলতে পারিস অন্যের মন নিয়ে’’, ভরসা দেন শিবুদা। ‘‘ওই যে তোর অফিসের মেয়েটা, যার সঙ্গে এক বছর ধরে প্রেম করার চেষ্টা করছিস, অথচ সে পাত্তাই দিচ্ছে না, তাকে পটিয়ে ফেলার উপায় বলে দিতে পারি।’’

‘‘যাঃ, অত সোজা?’’ তপেশের মুখে অবিশ্বাস, কিন্তু চোখে আগ্রহ। শিশিররা হাসতে আরম্ভ করে।

‘‘বলে দিচ্ছি, শোন। ২৬ তারিখ যুবভারতীতে আইএসএল-এর খেলা আছে, কলকাতা আর চেন্নাইয়ের। বলেকয়ে তোর সঙ্গে খেলাটা দেখতে যেতে রাজি করা। ঘাবড়াস না, ক্যান্ড্‌ললাইট ডিনারের চেয়ে বেশি এফেক্টিভ আইডিয়া দিচ্ছি। খেলার মাঠের উত্তেজনা, অ্যাড্রিনালিন রাশ— তোর স্মৃতির সঙ্গে মেয়েটার মনে জড়িয়ে যাবে এগুলোও। পরে যখন তোর কথা ভাববে, ওর অজান্তেই ওর মন এই উত্তেজনার কথা ভাববে, আর মনে করবে, উত্তেজনার কারণ ছিলি তুই। এর পরেও যদি প্রেম না হয়, তবে তুই নিতান্ত অপদার্থ।’’ তপেশের চুলটা ঘেঁটে দিয়ে মুচকি হাসেন শিবুদা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Money Psychology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE