Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

নৈতিক দ্বন্দ্ব কিন্তু আজও তীব্র

ছবির প্রথমার্ধ দেশে-বিদেশে শাখাপ্রশাখা মেলা একটি আধুনিক পরিবারের নানা সম্পর্ক নিয়ে টানাপড়েন। অকস্মাৎ কিছু ঘটনায় কাহিনি মোড় নিয়েছে, তার পরে সমান্তরাল রেখায় এগিয়েছে পারিবারিক আখ্যান এবং ক্রমশ ঘন হয়ে উঠেছে রহস্যকাহিনি।

মৈত্রীশ ঘটক
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

ভূতের ভবিষ্যতের দীর্ঘ চার বছর বাদে অনীক দত্তের নতুন ছবি মেঘনাদবধ রহস্য বর্ষাকালে মেঘের রথে চেপে এসে পৌঁছল। বর্ষা মানেই হৃদয় খুঁড়ে ঘাড় ধরে নিয়ে আসা দুঃখ, ঝাপসা জানলা দিয়ে হঠাৎ উঁকি মারা গত জন্মের স্মৃতির মতো মেঘ, ভিজে রাস্তায় পুরনো গান শুনে হৃদয়ে চোরাগোপ্তা তির, ঠিক যেমন মেঘের আড়াল থেকে নিক্ষেপ করতেন মেঘনাদ। ছবিটি রহস্যকাহিনির আঙ্গিকে এক আধুনিক পারিবারিক নাটক, কিন্তু আসলে এক রাজনৈতিক ছবি, যা শেষ বিচারে ন্যায়-অন্যায়ের চিরন্তন নীতিকথা। চলচ্চিত্র সমালোচনা নয়, সত্তর আর আশির দশকে বামপন্থী আবহাওয়ার কলকাতা শহরে বড় হয়ে ওঠা এক বাঙালি হিসেবে এই ছবি দেখে যে প্রতিক্রিয়া, তাই পেশ করছি।

ছবির প্রথমার্ধ দেশে-বিদেশে শাখাপ্রশাখা মেলা একটি আধুনিক পরিবারের নানা সম্পর্ক নিয়ে টানাপড়েন। অকস্মাৎ কিছু ঘটনায় কাহিনি মোড় নিয়েছে, তার পরে সমান্তরাল রেখায় এগিয়েছে পারিবারিক আখ্যান এবং ক্রমশ ঘন হয়ে উঠেছে রহস্যকাহিনি। আর তার সঙ্গে জলছবির মতো আস্তে আস্তে ফুটে উঠেছে রাজনৈতিক এক আলেখ্য: বাংলায় বাম ও প্রগতিশীল রাজনীতির যে নানা ধারা, সেই বৃহৎ বাম যৌথ পরিবারের নাটকও বলা যেতে পারে তাকে। সত্তর-আশির দশকের কলকাতায় বড় হয়ে ওঠা এমন কেউই প্রায় নেই যার আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশী-পরিচিত মহলে কেউ না কেউ নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েননি। তাই এই ছবির নকশাল নেতা ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী কোনও গল্পের চরিত্র নন, তিনি আমাদের বৃহৎ বাম-প্রগতিশীল যৌথ পরিবারের যেন কাকা-দাদার মতো এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রবাসী সাহিত্যিক-অধ্যাপক অসীমাভ বসুর সাজানো জীবনে এক বেনামি শাসানি হিসেবে অতীত জীবনের না-মেলা এক মারাত্মক হিসেব মেলানোর দাবি নিয়ে ভেসে আসে অমোঘ নিশির ডাকের মতো। সেই রহস্যের সমাধান যখন দর্শকের চেতনায় ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে, সেই স্রোতে ভেসে যায় অসীমাভর সযত্নে সাজানো সফল প্রবাসী সাহিত্যিক-অধ্যাপক জীবনের উজ্জ্বল আখ্যানটি।

এ এমন ডাক, যাতে সাড়া না দিয়ে কোনও উপায় নেই, আর এক বার সাড়া দিলে পুরনো জীবনে ফিরে যাবার কোনও পথও নেই। হয়তো তাই এই ছবিতে যে গানটি সবচেয়ে শক্তিশালী ধাক্কা দেয় তা কখনওই পুরোপুরি গাওয়া হয়নি, আবহসংগীতে তার সুরের রেশ আর মূল এক চরিত্রের স্মৃতিমেদুর গুনগুনানিতে তা হল, ‘পথে এ বার নামো সাথি’। পথ একই সঙ্গে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি আনে, আনে নতুন দিশার আশা, আবার পথ কখনও অসহনীয় বাস্তব থেকে মুক্তি পাবার এক প্রতীক-মাত্র, পথের শেষে যা-ই থাক না কেন।

শেষ দৃশ্যে যখন এক সন্তান যে জন্মের আগেই অনাথ হয়েছে, তার পিতার মৃত্যুস্থলে পুকুরের পাড়ে তন্ময় হয়ে বসে থাকে, তখন তা আর রহস্য বা রাজনৈতিক কাহিনি থাকে না। রাজনৈতিক যুক্তি-তক্কো, রহস্য বা আধুনিক এক পরিবারের নানা সম্পর্কের জটিল টানাপড়েন ছাপিয়ে চিরন্তন মানবিক অনুভূতির মেঘলোক থেকে পরিচালক এক চোরা তির নিক্ষেপ করেন দর্শকের হৃদয়ে মেঘনাদ-সুলভ অমোঘ দক্ষতায়। বর্ষার মেঘ, তাই খানিক বর্ষণ অনিবার্য।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই ছবির যে মেঘনাদ, তার বধে যে আঙুল ট্রিগার টিপেছিল শুধু সে নয়, যার বিশ্বাসঘাতকতায় তার গোপন ডেরার সন্ধান পাওয়া যায় শুধু সে নয়, যে রাষ্ট্রযন্ত্র মুখে গণতন্ত্র কিন্তু কাজে এনকাউন্টার কিলিং-এর উদ্ভাবক শুধু তা নয়, যে মতাদর্শ এবং নেতৃত্ব অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে এক প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ সন্তান-সন্ততিদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল, এবং আজও দিচ্ছে, তার দায়িত্ব কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বা অবাধ ধনতন্ত্র তো নৈতিক দিক থেকে কোনওমতেই সমর্থন করা যায় না। কিন্তু এদের সমর্থনে কথা বলার মতো লোক খুবই কম। আর স্বর্গের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সমাজতন্ত্রের বাস্তব যে চেহারাটা বেরোল সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপে, বা মাও-এর চিনে, তা হল মুক্তসমাজের বদলে একনায়কতন্ত্র, স্বাধীনতার বদলে নিপীড়ন, উন্নয়নের বদলে জনগণের জন্যে দারিদ্রের সমবণ্টন, আর পার্টির এলিট আর আমলাদের সামন্ততান্ত্রিক যথেচ্ছাচারের শোষণমূলক এক নির্মম চেহারা। এই বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া সোজা নয়।

তাই আজও আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক বামেরা এই নিয়ে স্বেচ্ছা-অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন। এই সব কথা উঠলেই তাঁরা “প্রতিক্রিয়াশীল” ইত্যাদি বলে আলোচনা থামিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, বৃহত্তর বাম-উদারপন্থী যে যৌথ পরিবারের আমরা অনেকেই সদস্য, যাদের ওপর অন্তত দলীয় আনুগত্যের চাপ নেই, সেখানেও এক গোষ্ঠীভিত্তিক মানসিকতা নৈতিক বোধকে অনেক সময়ে আচ্ছন্ন করে রাখে। দক্ষিণপন্থী কোনও দল বা সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তাঁরা মুখর হন, কিন্তু অন্যথা তাঁরা, “এগুলো অপপ্রচার”, “সব তথ্য জানা নেই”, বা “কেন হল সেটাও দেখতে হবে” এই ধরনের যুক্তির আশ্রয় নেন। যেমন, গো-রক্ষকেরা খুন করলে সেটা নিন্দনীয় আর মাওবাদীরা খুন করলে সেটা বিপ্লবী সংগ্রাম; আমেরিকার কোরিয়া-ভিয়েতনাম যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া, বা আফগানিস্তান আক্রমণ করলে সেটা সমর্থনীয় কাজ; বাংলায় মন্বন্তরের জন্যে চার্চিল বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দায়ী, কিন্তু চিনে পঞ্চাশের দশকের শেষে ভ্রান্ত সরকারি নীতির ফলে বিশাল যে মন্বন্তরে এর থেকে অনেকগুণ বেশি লোকের মৃত্যু হয়, তাতে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি বা তার নেতৃত্বের কোনও দায়িত্ব নেই, বা এগুলো অপপ্রচার, এই সব দ্বিচারিতার না আছে যুক্তি, না আছে মানবাধিকার রক্ষার প্রতি কোনও আন্তরিক অঙ্গীকার। আছে শুধু গোষ্ঠীভিত্তিক অন্ধ আনুগত্য। এর একমাত্র ফল, বাম-উদারবাদী রাজনীতির যে নৈতিক মূলধন, তার অবক্ষয়। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় জেএনইউ-এর উদীয়মান ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার বামপন্থার এই গোঁড়া অসহিষ্ণু চেহারার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদী অচলায়তনের যে তুলনা এনেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত হওয়া খুব মুশকিল।

বাম রাজনীতির বর্তমান যে করুণ হতশ্রী দশা আর পাশাপাশি দেশেবিদেশে দক্ষিণপন্থী শক্তির বর্বর উল্লাস, তাতে এই ছবির চরিত্র নকশাল নেতা ইন্দ্রজিতের মতো মানুষদের আদর্শবাদ, সাহস, এবং আত্মত্যাগ আমাদের আরও বেশি করে কষ্ট দেয়। তবে যত দিন দারিদ্র, অসাম্য, ও নিপীড়ন থাকবে, তত দিন শোষণহীন মুক্ত সমাজের স্বপ্ন বেঁচে থাকবে, ‘পথে এ বার নামো সাথি’ গানটি হৃত্স্পন্দন বাড়াবে, এবং পথভ্রান্ত হলেও এই ছবির ইন্দ্রজিতের মতো চরিত্রের আদর্শবাদ ও সাহস আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে নতুন পথ খুঁজতে। গোঁড়া বিশ্বাসের কানাগলি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে খুঁজতে হবে মনোরথের ঠিকানা। মেঘনাদ হত, কিন্তু মেঘনাদেরা অবধ্য।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE