Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
National News

এ কোন উলটপুরাণ!

অসমে পর পর ঘটছে নীতি-পুলিশি বা অনাকাঙ্খিত সামাজিক আক্রোশ চরিতার্থ করার ঘটনা। শুধু অসমে নয়, উত্তরপ্রদেশে ঘটছে, উত্তরাখণ্ডে ঘটছে, মহারাষ্ট্রে ঘটছে। দেশের নানা প্রান্তে সামাজিকতার স্বঘোষিত ধ্বজাধারীরা অতিশয় সক্রিয় হয়ে উঠছেন

নীতি-পুলিশি এ বার অসমের নগাঁও জেলায়।

নীতি-পুলিশি এ বার অসমের নগাঁও জেলায়।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৮ ০০:৫৯
Share: Save:

এটা কোন পথ? যে পথে আমরা হাঁটছি, যে দিশায় আমরা এগোচ্ছি, সভ্যতার মহাসড়কের মাইলফলকে সে দিকে যাওয়ার নির্দেশ কি রয়েছে? আমরা এক বারও ভাবছি না।

আবার নীতি-পুলিশি, এ বার অসমের নগাঁও জেলায়। এক যুবতীর বাড়িতে গিয়েছিলেন এক যুবক, আচমকা বাড়ি ঘিরে ফেলল উত্তেজিত জনতা, বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ওই যুবক-যুবতী ‘অবৈধ সম্পর্ক’ রেখে চলেছেন নিজেদের মধ্যে— এমনই অভিযোগ তোলা হল। যুবককে বেধড়ক মারধর করা হল, অকথ্য নির্যাতন চালানো হল। যুবতীর মাথা কামিয়ে দেওয়া হল। এটা সভ্যতার নমুনা? এটা সভ্য সমাজের নমুনা?

অসমে পর পর ঘটছে নীতি-পুলিশি বা অনাকাঙ্খিত সামাজিক আক্রোশ চরিতার্থ করার ঘটনা। শুধু অসমে নয়, উত্তরপ্রদেশে ঘটছে, উত্তরাখণ্ডে ঘটছে, মহারাষ্ট্রে ঘটছে। দেশের নানা প্রান্তে সামাজিকতার স্বঘোষিত ধ্বজাধারীরা অতিশয় সক্রিয় হয়ে উঠছেন। আইন-কানুন, সংবিধান বা সভ্য সামাজিকতার তোয়াক্কা করছেন না তাঁরা। বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারে মেতে উঠছেন। নিজেদের নাগরিক অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করছেন। অন্যের নাগরিক অধিকার হরণ করছেন। সামাজিকতা বা অসামাজিকতার ব্যাখ্যা করছেন নিজেদের মতো করে।

সভ্যতা কিন্তু আমাদের এ পথে এগনোর শিক্ষা দেয়নি। সভ্যতার সড়ক যত এগিয়েছে, তত প্রশস্ত হয়েছে। সভ্যতার শিক্ষা যত প্রসারিত হয়েছে মানবজাতি ততই উদার হয়েছে, ঋদ্ধ হয়েছে। সভ্যতার এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে সামাজিক অসহিষ্ণুতাও মাঝেমধ্যেই হানা দিয়েছে, কুসংস্কার মাথা চাড়া দিয়েছে, সামাজিক বিকৃতি বিচলিত করেছে, সামাজিক বিচারের নামে কখনও স্বেচ্ছাচারিতা, কখনও গোঁড়ামি, কখনও অন্ধত্বের চর্চা হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির পথে সেগুলো বাধা ঠিকই। কিন্তু সে বাধা কখনওই এত বড় হয়ে উঠতে পারেনি, যে সভ্যতার অগ্রগতির প্রবাহকে সে রুখে দেবে। বাধা-বিপত্তি মাথা তুলেছে, আবার ভেসেও গিয়েছে সুশিক্ষার তোড়ে। কিন্তু একবিংশ শতকে পৌঁছে যখন ঊনবিংশ বা অষ্টাদশ বা সপ্তদশ শতকে পরিত্যক্ত হওয়া ‘নীতি’কে মাথা চাড়া দিতে দেখি, সহ-নাগরিকদের কারও কারও মধ্যে যখন ওই সপ্তদশের দিকে বা তারও পশ্চাত্‌বর্তী মধ্যযুগের দিকে ছুটে যাওয়ার প্রবণতা দেখি, তখন নিজেদেরকে দুর্ভাগ্যপীড়িত বলে মনে হয়।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

মানবজাতির ইতিহাস বলছে, প্রত্যেকটি যুগের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট, পরিচয় চিহ্ন, চরিত্র রয়েছে। সে বৈশিষ্টগুলি যে সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক, তা মোটেই নয়। ইতিবাচক প্রবণতাগুলি পরবর্তী যুগে সংবাহিত হয়েছে। নেতিবাচক বৈশিষ্টগুলির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট যুগে লড়াই চলেছে এবং তার বর্জন ঘটেছে। তাই ঊনবিংশ বা অষ্টাদশ বা সপ্তদশ শতকের কোনও সঙ্কীর্ণতা বা মধ্যযুগের কোনও বর্বরতা এই একবিংশ শতকে সংবাহিত হবে, এমনটা কাম্য নয়। সভ্যতা নিজের যাত্রাপথে যা বর্জন করে এসেছে অনেক আগেই, এত দিন পরে তা ফের মাথা তুলবে, এমনটা সুলক্ষণ নয়।

আরও পড়ুন: নীতিপুলিশের তাণ্ডব অসমে, ‘পরকীয়া’র অভিযোগে মাথা কামানো হল মহিলার

সভ্যতার দিশা নির্দেশ আমাদের সকলকেই পড়তে জানতে হবে। সঙ্কীর্ণতা পিছনে ফেলে উদার মানবতার মহাসড়কে উপনীত আমরা। সামাজিক মাত্স্যন্যায় এবং স্বেচ্ছাচার পিছনে ফেলে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় উপনীত আমরা। এ কাঠামোয় আইনের শাসনই শেষ কথা। এ কাঠামোয় গণতান্ত্রিক মূল্যোবোধই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। স্বঘোষিত নীতি-পুলিশদের ঠাঁই এ কাঠামোয় নেই। সামাজিক নিশ্বাসে লুকিয়ে থাকা কিছু অন্ধকার এখনও লালন করে গোঁড়া, অসহিষ্ণু, মধ্যযুগীয় মানসিকতাকে। কিন্তু তার কাছে আত্মসমর্পণ করলে চলে না। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, সামাজিক আবর্জনাগুলোকে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করতে হয়। না হলে পথ ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

নীতি-পুলিশি যে ভাবে বাড়ছে দেশে, সামাজিকতার ব্যাখ্যা যে ভাবে নিজের মতো করে নিচ্ছি আমরা, অন্ধ রক্ষণশীলতাকে যে ভাবে ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’ বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে, তা আর বরদাস্ত করলে চলে না। এই সামাজিক গোঁড়ামি আমাদের উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সভ্যতার গতির সঙ্গে তাল মেলাতে দিচ্ছে না। এই উলটপুরাণ আমাদের রুখতেই হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE