Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Newsletter

পদক্ষেপটা আরও সতর্ক হতে পারত

অসমে বসবাসকারী ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাম বাদ পড়েছে এনআরসি থেকে। এত মানুষকে এক লহমায় রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া হবে? ভারতের নাগরিক নন বলে যাঁদের চিহ্নিত করা হল, অন্য কোনও রাষ্ট্র যদি তাঁদের দায়িত্ব নিতে না চায়, তা হলে কী হবে? এঁরা কি অনন্ত উদ্বাস্তু দশার দিকে এগোবেন? উঠছে এই সব প্রশ্নই।

নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর প্রতিবাদ। ছবি: এপি

নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর প্রতিবাদ। ছবি: এপি

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৮ ০০:৫৬
Share: Save:

ধরে নেওয়া গেল যে, নিয়ম-কানুনে কোনও ব্যতয় হয়নি। ধরে নেওয়া গেল যে, সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অক্ষরে অক্ষরে অনুসৃত হয়েছে। ধরে নেওয়া গেল যে, মানবিক ভুলচুক যা কিছু হয়েছে, সে সবও শুধরে নেওয়া হবে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে। কিন্তু তার পরেও খচখচানি একটা থেকেই যায়। প্রশ্নটা জেগেই থাকে। এনআরসি-র চূড়ান্ত খসড়াটা প্রকাশের আগে কি আরও একটু সতর্ক ভাবে পা ফেলা উচিত ছিল না?

জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি প্রকাশিত হয়েছে অসমে। তা নিয়ে গোটা দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত। অসমে বসবাসকারী ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাম বাদ পড়েছে এনআরসি থেকে। এত মানুষকে এক লহমায় রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া হবে? ভারতের নাগরিক নন বলে যাঁদের চিহ্নিত করা হল, অন্য কোনও রাষ্ট্র যদি তাঁদের দায়িত্ব নিতে না চায়, তা হলে কী হবে? এঁরা কি অনন্ত উদ্বাস্তু দশার দিকে এগোবেন? উঠছে এই সব প্রশ্নই।

অসমে কেন এনআরসি তৈরি হল, সে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। যে প্রক্রিয়ায় তৈরি হল, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল বিষয়টা। সর্বোচ্চ আদালতের সম্মতিতেই এই নাগরিক পঞ্জিকরণ হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত যে প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, সেই প্রক্রিয়াতেই হয়েছে। প্রশ্নটা উঠছে অন্যত্র। যে ভঙ্গিতে এনআরসি-র চূড়ান্ত খসড়াটি প্রকাশ করা হল, তা কিয়ৎ বেপরোয়া ঠেকল না কি? আরও সহানুভূতির সঙ্গে, আরও সহনশীল ভঙ্গিতে, আরও সুসংহত পরিকল্পনার উপরে দাঁড়িয়ে এই তালিকা প্রকাশ করলে ভাল হত না কি?

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

এনআরসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই তালিকা হল নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া। অর্থাৎ চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি এটি নয়। যাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, তাঁদের কাছে যদি ভারতীয় নাগরিক হওয়ার বৈধ নথি থেকে থাকে, তা হলে নাম অন্তর্ভুক্তির আবেদন-সহ সে সব নথি জমা দিতে বলা হয়েছে। সেই আবেদনের ভিত্তিতে এনআরসি সংশোধন করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু সে আশ্বাসে তো আশঙ্কা-আতঙ্ক-সংশয়ের বাতাবরণ ঠেকিয়ে রাখা গেল না। যাঁদের নাম এ বারও তালিকায় উঠল না, তাঁরা অনিশ্চয়তার আবহ অনুভব করতে শুরু করলেন স্বাভাবিক ভাবেই। অন্য দিকে, উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনও কোনও প্রান্তে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে বেশ কিছু সংগঠন অনধিকার চর্চা শুরু করল। দেশ বা মাতৃভূমির স্বঘোষিত রক্ষাকর্তা সেজে তারা অসমবাসীদের এনআরসি নথি পরীক্ষা করা শুরু করল, অশান্তি-মারধরের খবরও আসতে শুরু করল।

আরও পড়ুন: গুয়াহাটির হাজার হাজার বাঙালির চোখে নাগরিক-আশঙ্কা

এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের পরে অসমে যাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। অসম থেকে বড় অশান্তির খবর এখনও মেলেওনি। কিন্তু বহিরঙ্গের অশান্তিটাই কি সব? ভিতরে ভিতরে যে ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার আগুনে পুড়তে শুরু করেছেন হাজার হাজার মানুষ, তা কি অস্বীকার করার উপায় রয়েছে? পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই হোক বা অন্য কোনও কারণে, রাজনীতি যে উত্তাল হয়েছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে? দেশের একটি নির্দিষ্ট অংশে যে হঠাৎ সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে, তা কি অস্বীকার করতে পারব আমরা? পাশাপাশি বসবাসকারী বেশ কয়েকটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে অবিশ্বাসের পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছে, সে কথা কি অস্বীকার করা সম্ভব?

চূড়ান্ত তালিকায় যাঁদের নাম থাকবে না, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী হবে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তো সেটাই। চূড়ান্ত খসড়াটি প্রকাশের আগে সেই প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজে রাখা জরুরি ছিল না কি?

দশকের পর দশক ধরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সঙ্ঘাতের আবহ রয়েছে দেশের যে প্রান্তে, সেই স্পর্শকাতর ভূখণ্ডে এত সংবেদনশীল একটি বিষয় নিয়ে পদক্ষেপ করার আগে আরও অনেক বেশি সতর্ক হওয়া জরুরি ছিল। প্রশাসনের তরফে কোনও সতর্কতাই নেই, এমনটা হয়ত বলা যাচ্ছে না। কিন্তু যতটা মেপে পা ফেলা উচিত ছিল, ততটা যে হয়নি, উদ্ভুত পরিস্থিতিই তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE