Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

পাইয়ে দেওয়া বনাম বাজার

এমএসপি-র এই বৃদ্ধিকে শাসক দল ‘ঐতিহাসিক’ বলে চিহ্নিত করতে চাইছে। আর অন্য দিকে, বিরোধীরা তো বটেই, যাঁর নেতৃত্বাধীন কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বাড়ানো হল এমএসপি, সেই এম এস স্বামীনাথনই বলছেন, যা সুপারিশ ছিল, বাড়ানো হয়েছে তার অংশমাত্র। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, এই বৃদ্ধিতে কি লাভ হবে আদৌ?

সন্দীপ মিত্র
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৮ ০০:৫০
Share: Save:

চাষিদের কথা মনে পড়ার সময় এসে গিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের আর এক বছরও বাকি নেই। ২০১১ সালের জনশুমারি বলছে, এখনও দেশের প্রতি দশ জন মানুষের মধ্যে ছ’জনই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আর, তাঁদের সবার হাতে একটা করে ভোট। কাজেই, কৃষিতে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এমএসপি) বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য যে অনেকখানি বাড়ল, তাতে আর আশ্চর্য কী?

এমএসপি-র এই বৃদ্ধিকে শাসক দল ‘ঐতিহাসিক’ বলে চিহ্নিত করতে চাইছে। আর অন্য দিকে, বিরোধীরা তো বটেই, যাঁর নেতৃত্বাধীন কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বাড়ানো হল এমএসপি, সেই এম এস স্বামীনাথনই বলছেন, যা সুপারিশ ছিল, বাড়ানো হয়েছে তার অংশমাত্র। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, এই বৃদ্ধিতে কি লাভ হবে আদৌ? আমি একটা অন্য প্রশ্ন করতে চাই— এমএসপি দিয়ে আদৌ কি কোনও লাভ হয়? সে দাম যতই বাড়ানো হোক না কেন?

দেশে কৃষকের ক্ষোভ ক্রমে বাড়ছে। সে ক্ষোভ প্রশমনে নেতারা দুটো মোক্ষম ওষুধের কথা জানেন। এক, ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া, অথবা ঋণ মকুব করা, বা অন্য কোনও পথে কৃষির খরচ কমিয়ে আনা; দুই, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অঙ্ক বাড়ানো। কৃষকদের বিক্ষোভ থেকেও মূলত এই দুটো দাবিই ওঠে— যে কোনও সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সহজ উপায়। ঋণ বা ভর্তুকিতে কেন যথেষ্ট লাভ হয় না, সে বিষয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। তুলনায় সহায়ক মূল্যের অসাফল্য নিয়ে কথা হয়েছে কম। সেই প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

ইদানীং ভর্তুকি বা ঋণ মকুবের তুলনায় ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বৃদ্ধির দাবি উঠছে অনেক বেশি। কোনও বছর কোনও একটি ফসলের দাম বাজারে কী থাকবে, তার কোনও নিশ্চয়তা থাকে না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিবিধ কারণে ফসলের দাম এতই কম থাকছে যে, তাতে কৃষকের চাষের খরচই উঠছে না, লাভ হওয়া তো অনেক দূরের কথা। সরকার একটি নির্দিষ্ট দাম ঘোষণা করে জানিয়ে দেয়, কৃষকদের থেকে সেই দামে ফসল কিনতে সরকার দায়বদ্ধ। এরই নাম মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এমএসপি) বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য। বাজারের দাম যদি এমএসপি-র চেয়ে বেশি হয়, তবে কৃষক খোলা বাজারে বিক্রি করবেন, আর কম হলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে সরকারের কাছে বেচবেন, এটাই প্রতিষ্ঠিত যুক্তি।

কিন্তু, তাতেও সমস্যা রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সরকারের ঘরে ফসল বেচার জন্যও কৃষককে দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তার অনেক রকম কারণ থাকতে পারে। সরকারি ক্রয়কেন্দ্র অবধি ফসল নিয়ে যাওয়ার খরচ জোগাড় করতে না পারাও যেমন একটা কারণ, আবার চাষের জন্য মহাজনের থেকে ধার নেওয়া টাকা শোধ করার বাধ্যবাধকতাও একটি কারণ। ফলে, দেখা যাচ্ছে, ছোট চাষিদের পক্ষে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধাটুকু পাওয়াও দুষ্কর হচ্ছে। এখনও অবধি সরকার ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রের ভিতরে ঢুকতে পারেনি। তার ফলেও লাভ হচ্ছে বড় চাষিদের, এবং কৃষি ব্যবসায়ীদের। কারণ, তাঁরাই চাষের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী। বস্তুত, বাজারে দু’ধরনের দাম চালু থাকাতেও লাভ হচ্ছে এই গোষ্ঠীরই। সহায়ক মূল্য বাড়িয়েও এই সমস্যার সুরাহা হবে না।

এই যে মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভ, তার পক্ষে মাঝেমধ্যেই একটা যুক্তি দেওয়া হয়— এটা নাকি এক গোত্রের বিমার প্রিমিয়াম। একটু ভেঙে বলি। এই যুক্তি বলছে, ফসল ওঠার আগেই স্থানীয় মহাজন বা বড় চাষিরা ক্ষুদ্র চাষিদের জানিয়ে দেন, তাঁরা কোন দামে ফসল কিনবেন। বাজারের দাম তার চেয়ে কম থাকবে না বেশি, এটা তখনও জানা থাকে না। ফলে, সেই মহাজনদের ক্ষতিরও আশঙ্কা থাকে। চাষির থেকে কম দামে ফসল কিনে বেশি দামে বেচতে পারলে যে লাভ, সেটা অন্য বছরের, বা এই বছরেরই অন্য সময়ের, সম্ভাব্য ক্ষতিকে পুষিয়ে দেওয়ার জন্য। যুক্তিটা শুনতে ভাল, কিন্তু ভিত্তিহীন। কারণ, গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, মহাজনরা কার্যত প্রতি দিন ছোট চাষিদের জানান, তাঁরা কোন দামে ফসল কিনবেন। এবং, সেই দামটি বাজারের দামের সঙ্গে তাল মিলিয়েই ওঠা-নামা করে। ছোট চাষির হাতে তিনটে বিকল্প থাকে— এক, মহাজনের দেওয়া দামে ফসল বেচতে পারেন; দুই, দাম বাড়ার প্রত্যাশায় ফসল ধরে রাখতে পারেন; তিন, আশেপাশের অন্য বাজারে চলে যেতে পারেন। শেষ দু’টি বিকল্প নেওয়া অনেক চাষির পক্ষেই অসম্ভব। ফলে, তাঁরা মহাজনের ধরে দেওয়া দামেই ফসল বেচতে বাধ্য হন।

পরিসংখ্যান বলছে, উপভোক্তার বাজারে দাম বাড়লে তার কার্যত কোনও প্রভাবই ছোট কৃষকের কাছে পৌঁছয় না, কিন্তু পাইকারি বাজারে তার প্রভাব পড়ে ভালমতো। অর্থাৎ, লাভের গুড় খেয়ে যায় মধ্যস্বত্বভোগীরা। সমাধান কোথায়? ছোট কৃষকের কাছে বাজার পৌঁছে দেওয়াই সমাধান। কৃষককে বাজারের সঙ্গে জুড়ে নিতে হবে। তার একটা দিক হল উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থা। কৃষককে যাতে বাজারে পৌঁছতে প্রবল খরচ না করতে হয়, তা নিশ্চিত করা। আর এক দিক হল বাজারকে পৌঁছে দেওয়া কৃষকের দোরগোড়ায়। রাজ্য সরকারগুলিকে এপিএমসি আইনকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। আরও একটি দিক হল তথ্য। নিকটস্থ বাজারে ফসলের কী দাম চলছে, বহু ক্ষেত্রেই কৃষকের সে বিষয়ে কোনও ধারণাই থাকে না।
আজকের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এই অবস্থাটি সম্পূর্ণ অর্থহীন। কৃষকের কাছে যাতে খুচরো ও পাইকারি বাজারের দাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য পৌঁছয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।

এই ব্যবস্থাগুলো দিয়ে সরাসরি রাজনীতি হবে না। কিন্তু, যাতে রাজনীতির লাভ হয়, তাতে যে কৃষকের লাভ নেই, সে কথাটাও কি এত দিনে সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়?

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা-য় অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE