Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

আতিথেয়তা

অসৌজন্যের উত্তরে সৌজন্যের এই দৃষ্টান্ত ভারতের নাকটি ঘষিয়া দেখাইয়া দিল, মোদীর ভারতে জাতীয়তাবাদ নামক বস্তুটি কোন অশালীনতায় নামিয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৮ ০০:২৪
Share: Save:

পড়শির মুখ দেখা বন্ধ করিবার জন্য তাহা হইলে এই দেশ উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছে। পাকিস্তানের আরও এক জন কবি-সমাজকর্মী মুনিজ়া হাশমিকে রীতিমতো অপমান করিয়া ভারত-ছাড়া করা হইল। দিল্লির একটি সরকারি সভায় অংশগ্রহণ করিবার জন্য তিনি আমন্ত্রিত হইয়াছিলেন, তাঁহার পাসপোর্টে বৈধ ভারতীয় ভিসা ছিল, লাহৌরের ভারতীয় দূতাবাস তাহাতে ছাপ মারিয়াছিল, দিল্লির বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন তাঁহাকে ঢুকিতে দিয়াছিল। কিন্তু হোটেলে আসিবার পর তিনি জানিতে পারিলেন যে কোনও সরকারি হোটেলেই তিনি থাকিতে পারিবেন না, কেননা উদ্দিষ্ট সভায় না কি তাঁহার যোগ দিবার অধিকার নাই। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাইয়া মুনিজ়া কেবল চুপ করিয়া সভায় উপস্থিত থাকিতে পারার অনুমতিটুকু চাহেন। চিঁড়া ভিজে নাই। যে দেশের সংস্কৃতি বলিত অতিথিদেবো ভব, তাহার যোগ্য আচরণই বটে! মুনিজ়া দেশে ফিরিয়া যাওয়াই সম্মানজনক বিবেচনা করেন, এবং বিমানের অপেক্ষা না করিয়া ওয়াগা সীমান্ত দিয়া পত্রপাঠ প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরিবার আগে ৭২ বৎসর বয়সি মানবতাবাদী সংস্কৃতিকর্মী বলিয়া যান, যাহাই ঘটুক না কেন, ভারতের সহিত শান্তির হাত মিলাইতে, ভারতের শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানাইতে তাঁহার গোষ্ঠী ভবিষ্যতে মুক্তহৃদয়ে প্রস্তুত থাকিবে।

অসৌজন্যের উত্তরে সৌজন্যের এই দৃষ্টান্ত ভারতের নাকটি ঘষিয়া দেখাইয়া দিল, মোদীর ভারতে জাতীয়তাবাদ নামক বস্তুটি কোন অশালীনতায় নামিয়াছে। এই জাতীয়তাবাদের সিদ্ধান্ত: পাকিস্তান শত্রু দেশ, তাই পাক নাগরিকমাত্রেই ভারতীয় রাষ্ট্রের অপমানের লক্ষ্য। ভারত-পাকিস্তান অ-সখ্য নূতন নহে, কিন্তু গত চার বৎসর বুঝাইয়া দিয়াছে, রাষ্ট্রীয় স্তরের শত্রুতা-পারদ চড়াইবার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক স্তরে সেই রাষ্ট্রীয় শত্রুতার চূড়ান্ত প্রদর্শন ঘটাইতেও মোদী সরকার বদ্ধপরিকর। পাক নাগরিকরা যাহাতে ভারতে আসিবার (দুঃ)সাহসও না দেখান, তাহা নিশ্চিত করিতে সচেষ্ট। ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে উর্দু সাহিত্য সভার মাঝ পথে এই ভাবেই কিশওয়ার নাহিদকে ভারত-ছাড়া করা হয়। তাহার দুই মাস আগে ২০১৬-র ডিসেম্বরে পাক-বংশোদ্ভূত বলিয়া দুই মার্কিন গায়ক ভগ্নীকে ভারতে আসার ভিসা দিতে অস্বীকার করা হয়। পাক কবাডি খেলোয়াড়েরও একই দুর্নিয়তি হয়। প্রকাশ্য সভায় জনতার হাতে পাক শিল্পীদের অপমানিত হওয়ার ঘটনাগুলি না-হয় এখানে না-ই উল্লিখিত হইল।

প্রসঙ্গত, মুনিজ়া হাশমি প্রখ্যাত উর্দু কবি ফৈজ় আহমেদ ফৈজ়-এর দুহিতা। মুনিজ়া যে গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হইয়া আসিতেছিলেন, সেটির নামও ফৈজ় ফাউন্ডেশন। মুনিজ়ার পিতার কাব্য দেশভাগের বিদীর্ণ বেদনা ফুটাইয়া তুলিয়াছিল। ধর্মের মুখোশ পরিয়া অমানবিকতা কী ভাবে দাপাইয়া বেড়ায়, উপমহাদেশকে মনে রাখিতে বলিয়াছিল। মুনিজ়ার ঘটনা প্রমাণ, বর্তমান ভারতে সেই অমানবিকতার আবারও কী উদ্দাম দাপাদাপি। ইহা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলিয়া সেই ভারত উড়াইয়া দিতেও চায় না, বরং সদর্পে ঘোষণা করিতে চাহে যে, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভারত ‘নো এন্ট্রি জ়োন’। তাহাতেই সেই সরকারের জনপ্রিয়তা, ভোটবৃদ্ধি, রাজনীতির পোষণ ও তোষণ। ইহারই নাম সঙ্ঘ পরিবারের জাতীয়তাবাদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Moneeza Hashmi New Delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE