Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রকৃত ভারত

ভারতবর্ষে ধর্মীয় সম্প্রীতির আসল সুরটিও এই মিরপুর গ্রামের মতোই দৈনন্দিনতা বা স্বাভাবিকতার মধ্যেই লুকাইয়া আছে। সেখানে সদম্ভে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার প্রচণ্ড তাগিদ নাই।

হি‌ন্দু প্রতিমার চুল তৈরি করিতেছেন মিরপুরের মুসলমান শিল্পীরা।

হি‌ন্দু প্রতিমার চুল তৈরি করিতেছেন মিরপুরের মুসলমান শিল্পীরা।

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:২০
Share: Save:

হি‌ন্দু প্রতিমার চুল তৈরি করিতেছেন মুসলমান শিল্পী— ইহা অপেক্ষা বড় সম্প্রীতির উদাহরণ আর কী-ই বা হইতে পারে! দেশ জুড়িয়া যখন ধর্মীয় মেরুকরণের তুমুল রাজনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত, তখন মিরপুরের গ্রামটিকে একচিলতে দীপের আলো মনে হওয়াই স্বাভাবিক। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সেই অখ্যাত গ্রামের কয়েক ঘর মুসলমান শুধুমাত্র প্রতিমার চুল তৈরি করিয়াই সংবৎসরের অন্নসংস্থান করেন। ধর্মীয় সম্প্রীতির এ হেন নিদর্শন তবে এত কাল চোখ এড়াইয়া থাকিল কী উপায়ে? কারণ, সম্প্রীতির মুখরাই কোনও রকম প্রচারের আলো চাহেন না। হিন্দু পূজায় অংশী হইবার পশ্চাতে সেই মুসলমান শিল্পীদের কোনও মাইলফলক গড়িবার উদ্দেশ্য কাজ করে না, ইহাই তাঁহাদের রুজিরুটি, তাঁহাদের দৈনন্দিনতা। সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘সম্প্রীতি’র মতো বড় এবং ভারী শব্দের কোনও স্থান নাই।

ভাবিয়া দেখিলে, ভারতবর্ষে ধর্মীয় সম্প্রীতির আসল সুরটিও এই মিরপুর গ্রামের মতোই দৈনন্দিনতা বা স্বাভাবিকতার মধ্যেই লুকাইয়া আছে। সেখানে সদম্ভে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার প্রচণ্ড তাগিদ নাই। বরং আছে এক স্নিগ্ধ সাবলীল ধারা। প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি আদানপ্রদানের মধ্য দিয়া যে সাবলীলতা সুন্দর ভাবে প্রতিষ্ঠিত। পূজা সমীপে সেরা পোশাকটি বানাইবার লক্ষ্যে মুসলিম দর্জির দ্বারস্থ হইলে, নবমীর মহাভোজের প্রাক্কালে মুসলিম মাংসবিক্রেতার দোকানে লাইন লাগাইলে বা উৎসবের দিনে ঘর রং করিবার দায়িত্বটি মুসলিম মিস্ত্রির হাতে নিশ্চিন্তে সমর্পণ করিলে তাহাকে আলাদা করিয়া ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নজির’ বলা যায় না। তাহা পূর্ব দিকে সূর্য উঠিবার মতোই সত্য এবং স্বাভাবিক। সোশ্যাল মিডিয়ায় সদ্য জনপ্রিয় একটি ভিডিয়োয় দেখা যাইতেছে, জনৈক হিন্দু ভদ্রলোক গণেশ মূর্তি কিনিতে দোকানে আসিয়া গণপতি বাপ্পার বিভিন্ন মুদ্রা ও রূপের অর্থ বিক্রেতার মুখে শুনিয়া চমৎকৃত হন। শেষে জানিতে পারেন বিক্রেতা এক মুসলমান। দীর্ঘ দিনের লালিত সংস্কার সজোরে ধাক্কা খায়, কিন্তু দ্রুত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটাইয়া মানবধর্মেরই জিত হয়। ইহা ধর্মনিরপেক্ষতা কি না জানা নাই, কিন্তু ইহা সংস্কারের বিরুদ্ধে দৈনন্দিনতার জয়। কোনও ভারী বুলি নহে, দৈনন্দিন প্রয়োজনের তাগিদেই বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পরস্পর-নির্ভরতার দায়। তাই বাহিরের ঝড়-ঝাপ্টা সত্ত্বেও মিরপুরের মতো জনস্থান আজও নিশ্চিন্তে জীবিকা নির্বাহ করিতে পারে।

সমস্যা হইল, সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলি দেশের সেই নিশ্চিন্ত কাঠামোটিকেই নষ্ট করিবার লক্ষ্যে ধাবিত হইতেছে। ভোটবাক্সের প্রয়োজনে অধুনা ক্ষমতাসীন দল সম্প্রীতিকে, অর্থাৎ সেই স্বাভাবিক দৈনন্দিনতাকে ভাঙিয়া ফেলিতে বদ্ধপরিকর। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম প্রতিষ্ঠার জিগির তুলিয়া খাদ্যাভ্যাস হইতে ইতিহাস— সর্বত্রই তাহারা বিভাজনের রেখা টানিতে ব্যস্ত। প্রসঙ্গত, বিরোধীরাও কি অনেক সময় ভুলিয়া যান যে, উচ্চ তারে বাঁধা ধর্মনিরপেক্ষতার নিনাদটিও অনেক সময়ে সম্প্রীতির নিজস্ব ছন্দকে ব্যাহত করিতে পারে? প্রয়োজন এখন, বিভিন্ন ধর্মের সামাজিক সহাবস্থানকে আলাদা ভাবে বিজ্ঞাপিত না করিয়া, যাহা স্বাভাবিক, যাহা সত্য, তাহাকে কী ভাবে রাজনীতির ছোঁয়াচ হইতে বাঁচাইয়া রাখা সম্ভব, তাহাই বিবেচনা করা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hindu Muslim India Wig
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE