তিনসুকিয়ার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পিছনে কে বা কাহারা দায়ী, তাহা হয়তো কোনও দিনই স্পষ্ট ভাবে জানা যাইবে না। হয়তো তাহা শেষ পর্যন্ত প্রহেলিকা হইয়াই থাকিয়া যাইবে। প্রথমে যাহাদের দায়ী বলিয়া মনে করা হইয়াছিল, সেই ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম (আলফা) দায় অস্বীকার করিয়াছে। এই অস্বীকারে সত্য থাকিতে পারে, আবার না থাকাও সম্ভব। সত্য থাকিলে বলিতে হয়, অন্য কোনও দল কিংবা গোষ্ঠী নিজ সঙ্কীর্ণ স্বার্থের জন্য এই ঘৃণ্য কাজ করিয়াছে। এমনও সন্দেহ করা যায় যে, অপর দলকে বিপদে ফেলিবার জন্যই এ কাজ করা হইয়াছে। এই ধরনের নিকৃষ্ট অথচ ধোঁয়াবৃত অপরাধ অসমে নূতন ঘটনা নয়। তবে এই বারের বিশেষত্ব এইখানেই— আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ভারতের নাগরিকত্ব আইনের জটিলতা ও অসমের নাগরিকপঞ্জির সহিত এত রকম রাজনৈতিক স্বার্থ জড়াইয়া গিয়াছে যাহাতে ‘সকলেই সকলকে আড়চোখে দেখিতে’ ও অপরাধী প্রমাণ করিতে প্রস্তুত। এমনিতেই ঐতিহাসিক কারণে অসমের পরিস্থিতিটি অত্যন্ত বিশেষ রকমের। ২০১৯-এর দোরগোড়ায় সেই পরিস্থিতি আরও ভয়ানক রকমের বিশেষ হইয়া উঠিতেছে। রাতের অন্ধকারে পাঁচ নিরপরাধ নিরস্ত্র বঙ্গভাষীকে লাইন করিয়া বসাইয়া খুন করিবার মধ্যে রাজনৈতিক পঙ্কিলতার দুর্গন্ধটি অসহনীয়।
এই পরিব্যাপ্ত দুর্গন্ধের মধ্যে একটি কথা ক্রমশ স্পষ্ট। ভারতের নাগরিকত্ব আইনে (৬ নম্বর ধারা) সারা দেশের জন্য এক প্রকার নিয়ম এবং অসমের জন্য একটি বিশেষ আইনের (৬-ক নম্বর ধারা) দূরত্বের কারণে যে সমস্ত অসমবাসীকে এনআরসি-র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যাইতেছে, রাজ্যের বেশ কিছু স্বার্থকে তাহা আঘাত করিতে উদ্যত। সুতরাং এনআরসি বস্তুটিই এখন অতীব বিতর্কিত। অসমের এই সংশোধনী ধারাটিকে লইয়া বিচারের জটিলতা কবে কী ভাবে মিটিবে, জানা নাই। সুপ্রিম কোর্টে সদ্য-অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি গত ফেব্রুয়ারি মাসে নূতন বেঞ্চ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, কিন্তু সময়সীমা জানান নাই। যদি এই ধারা কোনও ভাবে অসাংবিধানিক সাব্যস্ত হয়, তবে সমগ্র এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়াটিই অপ্রাসঙ্গিক হইয়া যাইবে, এবং অসমের আইনি বা বেআইনি অভিবাসীরা সকলেই বিপন্ন হইয়া পড়িবেন। এই প্রদেশের বাঙালি-বিরুদ্ধতার দীর্ঘকালীন আবেগের মধ্যে এই হিসাবটি এখন সহসা অত্যন্ত বিদারক হইয়া উঠিয়াছে। তাই মৃণাল হাজরিকা ও জিতেন দত্তরা নিরপরাধ হউন বা না হউন, অসমে বাঙালি মুসলিমদের সঙ্গে বাঙালি হিন্দুদেরও আর নিরাপদ বোধ করা কঠিন।
তৃণমূল কংগ্রেস নিহতদের পরিবারের প্রতি ন্যায়বিচারের দাবিটি দরকারে রাষ্ট্রপতির দরবার পর্যন্ত লইয়া যাইবার আশ্বাস দিয়াছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালও বলিয়াছেন, তাঁহার সরকার অপরাধ সংঘটনকারীদের এবং উস্কানিদাতাদের শায়েস্তা করিবে। দলীয় রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার উপরে উঠিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সে রাজ্যের শাসক দলেরই করিবার কথা বটে। অভিজ্ঞতা অবশ্য বলিতেছে, প্রত্যাশা পূর্ণ হইবার সম্ভাবনা বিপজ্জনক রকমের কম। নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি-কে কেন্দ্র করিয়া বিষায়িত আবহের মধ্যে কেন্দ্রীয় শাসক দল ও রাজ্য প্রশাসনের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ পূরণের বহুবিধ উপাদান উপস্থিত। সেগুলিকে কাজে লাগাইয়া হিন্দু অভিবাসী ও মুসলিম অভিবাসীর মধ্যে দূরত্ব তৈরির কৃৎকৌশলে বিজেপি মাতিয়া উঠিতে পারে, অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদীদের রাজত্বে এমন আশঙ্কাই স্বাভাবিক। অথচ অন্তত অসমের ক্ষেত্রে তাঁহাদের সাবধান হওয়া খুব জরুরি— এ রাজ্যের জনজীবন এখন আক্ষরিক ভাবে বারুদস্তূপে অগ্নিসংযোগের পূর্বমুহূর্তটিতে দাঁড়াইয়া। মোদী-সোনোয়ালরা কি পরিস্থিতির চরম গুরুত্ব বুঝিতেছেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy