Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

প্রেম বনাম ভীতি

প্রশ্নটি আদালতের অতিসক্রিয়তারও বটে। সরকারি চাকুরির পরীক্ষায় প্রশ্ন আসিয়াছিল, ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি কোন ভাষায় লেখা? এক পরীক্ষার্থী উত্তর দিয়াছিলেন, বাংলায়।

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

প্রেক্ষাগৃহে বাধ্যতামূলক জাতীয় সংগীতের সহিত বাধ্যতামূলক দাঁড়াইয়া থাকা অভ্যাস হইয়াছে কি হয় নাই, মাদ্রাজ হাইকোর্ট নির্দেশ দিল, স্কুল, কলেজ, এমনকী অফিসেও ‘বন্দে মাতরম্‌’ গাহিতেই হইবে। গোটা দেশ জুড়িয়াই এখন জাতীয়তাবাদের প্লাবন। স্বয়ং উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সাজোঁয়া গাড়ি বসাইয়া দেশপ্রেম পোক্ততর করিবার উদ্যোগ করিতেছেন। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, ঘাড় ধরিয়া দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে বাধ্য না করিলেই কি নহে? দেশপ্রেম বস্তুটি গুরুত্বপূর্ণ, ভালও বটে। দেশ যদি ভালবাসার মতো হয়, নাগরিকরা নিঃসন্দেহে তাহাকে ভালবাসিবেন। যেমন, সন্তান মা-কে ভালবাসে। কিন্তু প্রতি দিন চৌরাস্তার মোড়ে হাজির হইয়া মা-কে ষষ্টাঙ্গে প্রণাম না করিলে রাষ্ট্র আসিয়া কান মলিয়া দিবে, এমন একটি নিয়ম বাঁধিয়া দিলে কি সেই ভালবাসার পরিমাণ বাড়িবে? আশঙ্কা হয়, দেশপ্রেমের প্রদর্শনীর হুকুমে প্রেমের তুলনায় ভয়ের ভাগ বেশি। রাষ্ট্রকে, এবং গৈরিক বাহিনীকে ভয় পাইয়া সাধারণ মানুষ দেশপ্রেমের নমুনা পেশ করিয়া চলিবেন— এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য। মহামান্য আদালতের নিকট প্রশ্ন, বাধ্যতামূলক ‘বন্দে মাতরম্‌’-এর আদেশ কি সেই ভয়ের রাজত্বেরই আর একটি অস্ত্র হইয়া উঠিবে না?

প্রশ্নটি আদালতের অতিসক্রিয়তারও বটে। সরকারি চাকুরির পরীক্ষায় প্রশ্ন আসিয়াছিল, ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি কোন ভাষায় লেখা? এক পরীক্ষার্থী উত্তর দিয়াছিলেন, বাংলায়। এই উত্তরের কারণে তাঁহার চাকুরি হয় নাই। এই উত্তরের কারণে তাঁহাকে চাকুরি হইতে বঞ্চিত করা যায় কি না, তাহা জানিতেই পরীক্ষার্থী আদালতের দ্বারস্থ হইয়াছিলেন। হাইকোর্টের রায় তামিলনাড়ু সরকারের বিপক্ষে গিয়াছে। এইখানেই মামলাটির পরিসমাপ্তি হওয়া বিধেয় ছিল। কিন্তু, আদালত স্বপ্রবৃত্ত হইয়া সর্বত্র ‘বন্দে মাতরম্’ গাহিবার আদেশ দিয়াছে। প্রশ্ন উঠিবে, এই মামলার সহিত এহেন আদেশের সম্পর্ক কোথায়? বিচারবিভাগের কাজ হইল সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচারাধীন মামলার নিষ্পত্তি করা— দেশের চরিত্রগঠন তাহার প্রাথমিক কর্তব্যতালিকার অন্তর্গত নহে। বস্তুত, দেশ জুড়িয়া চলা যে কোনও প্রবাহ হইতেই বিচারবিভাগ একটি নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব বজায় রাখিবে, তাহাই প্রত্যাশিত। কেহ যদি মাদ্রাজ হাইকোর্টের আদেশে সেই দূরত্বের অভাব বোধ করেন, তবে তাহাকে দোষ দেওয়া চলিবে না।

এক্ষণে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চরিত্র লইয়াও একটি প্রশ্ন অনিবার্য হইয়াছে। ইহা বর্ণে গৈরিক, ধর্মে হিন্দু। কিন্তু, এই জাতীয়তাবাদের ভাষা কী? শুধু সংস্কৃতিতে নহে, ভাষাতেও এই জাতীয়তাবাদ হিন্দি। বিভিন্ন উপলক্ষে কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা যে ভঙ্গিতে গোটা দেশের উপর হিন্দির আধিপত্য চাপাইয়া দিতে উদগ্রীব, তাহাতে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির বিচলিত হইবার যথেষ্ট কারণ আছে। হিন্দি এই দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। কিন্তু, তাহা প্রধান নহে, একমাত্র হইবার তো কোনও প্রশ্নই নাই। কাজেই, জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নির্মাণে হিন্দিকে সুকৌশলে ভারতের ধারণার সহিত জুড়িয়া দেওয়া হইলে অন্য ভাষাগুলির গুরুত্ব বিপুল ভাবে খণ্ডিত হয়। ‘বন্দে মাতরম্’ কিন্তু বাংলা ভাষায় রচিত। ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’-র ভাষাও বাংলা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Patriotism National anthem
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE