চিন দেশের শি আন শহরে একশো মিটারের একটি রাস্তা নিবেদিত হইয়াছে কেবল মোবাইল-মগ্ন পথচারীর জন্য। ইহাই বিশ্বের প্রথম ‘ফাবার’ সরণি। যাঁহারা ফোন-নিবিষ্ট হইয়া বিশ্ব ভুলিয়া যান, তাঁহাদের বুঝাইতে নূতন এই শব্দটির সৃষ্টি হইয়াছে: ফাবার। তাঁহাদের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নূতন পথ। চোখ না উঠাইয়াই রাস্তাটিকে যাহাতে চেনা যায়, তাই তাহা লাল, সবুজ ও নীল রঙে রঞ্জিত হইয়াছে, স্থানে স্থানে মোবাইল ফোনের ছবিও আঁকা রহিয়াছে। আলাদা রাস্তা থাকিবার ফলে গাড়িতে ধাক্কা লাগিবার ভয় নাই, অপরের বিরক্তি উদ্রেক করিবার সঙ্কোচ নাই। বিপরীত দিক হইতে আগত পথচারীর সহিত ধাক্কা লাগিবার সম্ভাবনা অবশ্য রহিয়া গিয়াছে, কিন্তু ‘ফাবার’ ব্যক্তিরা স্বভাবত ধীরগতি, তাই ক্ষতির আশঙ্কা কম। এত দিন মোবাইল-মগ্নতাকে সামাজিক ব্যাধি বলিয়া গণ্য করিবার একটি প্রবণতা ছিল। স্কুল-কলেজ, দফতর-আদালতে কখনও মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ, কখনও তাহার ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করা হইয়াছে। কারণ, দৈনন্দিন সামাজিক জীবনে মানুষে-মানুষে আদানপ্রদানে মোবাইল-মগ্নতা বাধা হইতেছে, এই অভিযোগ উঠিয়াছে। চিনেরও অনেকে আক্ষেপ করিয়াছেন, চিং বংশে আফিম যে ভাবে মানুষকে নেশাগ্রস্ত করিয়াছিল, মোবাইল ফোন আজ সেই কাজটিই করিতেছে। মানুষকে সমাজ-সংসারের প্রতি উদাসীন করিয়া তুলিতেছে।
তবে কি এই রাস্তা তৈয়ারি ভুল হইল? সর্বদা, সর্বত্র ফোন-নিবিষ্ট থাকিবার অভ্যাস হইতে মানুষকে না সরাইয়া শি আন নগরকর্তারা ফাবারদের উৎসাহিত করিলেন, এমন অভিযোগ উঠিতে পারে। তাঁহারা অবশ্য এ বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা করেন নাই। কিন্তু তাঁহাদের, তথা ফাবারদের পক্ষে যুক্তিও কম নাই। যাহাতে অধিকাংশ মানুষ অভ্যস্ত তাহাই ভাল, তাহাই প্রার্থনীয়— ইহা কেবল চিন্তার জড়তা। নূতন প্রযুক্তি আসিলে সাবেকিরা বিপর্যস্ত বোধ করেন, তাহাতেই ‘গেল গেল’ রব তোলেন। চলচ্চিত্র মূক হইতে সবাক হইলে চার্লি চ্যাপলিন আক্ষেপ করিয়াছিলেন, সিনেমার স্বর্ণযুগ গিয়াছে। টেপ রেকর্ডারের প্রচলন শুরু হইলে অনেকে আশঙ্কা করিয়াছিলেন, সাংবাদিকতার অবমূল্যায়ন হইবে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়াছে, প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে আরও সহজ ও অর্থপূর্ণ করিয়াছে। ক্ষুদ্র স্মার্টফোনে ধৃত বিভিন্ন প্রযুক্তি আজ জ্ঞানে, বিনোদনে, সৃষ্টিশীলতার স্ফুরণে সকলকে যত ভাবে সম্পন্ন করিতেছে, পূর্বে তাহা কল্পনাতীত ছিল।
মোবাইল-মগ্ন মানুষটি জীবনবিচ্ছিন্ন, এই ধারণাটিও পুনরায় বিবেচনার প্রয়োজন। একই ঘরে একত্র থাকিয়াও চার-পাঁচটি মানুষ বস্তুত চার-পাঁচটি ভিন্ন মানসবিশ্বে বিচরণ করে না কি? কেহ রহিয়াছে খেলার মাঠে, কেহ গানের আসরে, কেহ ধর্মস্থানে, কেহ শেয়ারবাজারে, কেহ বা টিভি সিরিয়ালে পরিদৃষ্ট কাহিনিজাল নিজের মনে নূতন করিয়া বুনিয়া ফিরিতেছে। সমমনস্কদের মধ্যে নিয়ত সংযোগ করাইয়া আধুনিক প্রযুক্তি তাহাদের মানসভুবনকে আরও জীবন্ত করিতেছে। নতুবা তাহার প্রতি এই দুর্নিবার আকর্ষণ জন্মাইত না। ‘ফাবার’ সমাজবিমুখ নহে, সে নিজের সমাজ নিরন্তর নিজেই গড়িতেছে। তাহার পথ সে করিয়াই লইয়াছে, পুরকর্তারা তাহা স্বীকার করিলেন মাত্র। চিনের শি আন শহর পথ দেখাইল বিশ্বকে। নূতন পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy