মাস দুয়েক আগে, চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইনস ডে, ফ্লরিডার পার্কল্যান্ড স্কুলে সতেরোটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল, এ আর নতুন কী, ক’টা দিন এ দেশের মান্যগণ্য জনপ্রতিনিধিরা খানিক লোকদেখানো শোক প্রকাশ করবেন, মৃতদের আত্মার শান্তির প্রার্থনা করবেন, তার পর আর একটা রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের জন্য অপেক্ষা। তাঁরা বলবেন দ্বিতীয় অ্যামেন্ডমেন্ট-এর প্রেক্ষিতে বন্দুক কেনা ও ব্যবহার করা মার্কিনদের সংবিধান-দত্ত অধিকার, তা কোনও ভাবেই বদলানো যায় না। এ-ও বলবেন, বন্দুকবাজ যদি শ্বেতাঙ্গ হয়, তবে নির্ঘাত তার মাথার ব্যামো ছিল। যদি বাদামি বা কালো চামড়ার মানুষ হয়, সহজেই বোঝা যায় যে সে আতঙ্কবাদী। বিতর্ক ঘুরে যাবে অন্য দিকে। ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশান বা এনআরএ-র কাছে চাঁদা নেননি, এমন রাজনীতিবিদ এ দেশে বিরল। তাঁরা যে কিছু করে উঠবেন, সে আশা খুব কম মানুষই পোষণ করেন।
দুই মাস পর ফিরে তাকিয়ে কিন্তু বলতেই হয়, পার্কল্যান্ড ঘটনা চেনা ছকটা ওলটপালট করে দিয়েছে। স্বজন খোয়ানোর দুঃখ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা জেদের জন্ম দিয়েছে, আর তাদের এই জেদ, বন্দুক সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান করে দেখানোর সৎসাহস যেন নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে আমাদের মনেও নতুন উদ্যম, উৎসাহ ও জোর এনে দিয়েছে। হঠাৎ মনে হচ্ছে এ বার একটা রদবদল হবে, পারলে এরাই পারবে যা আমরা, এদের অভিভাবকরা, সাহসে ভর দিয়ে করে উঠতে পারিনি।
সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে এই প্রজন্ম সিদ্ধহস্ত। তা নিয়ে আমরা এদের কম কথা শোনাই না। সর্ব ক্ষণ ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ করেই যে এদের ভবিষ্যৎ রসাতলে যাচ্ছে, সে বিষয়ে আমরা সবাই একমত। কিন্তু আশ্চর্য, এই সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করেই এরা একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল। যে বন্দুকের গুলি তাদের সহপাঠী ও শিক্ষকদের অকালপ্রয়াণের জন্য দায়ী, তার একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করার দাবি তুলল। কঠিন সত্যিকে সহজ করে বলার গুণ এদের মধ্যে রয়েছে, এরা ফ্লরিডার সেনেটর রুবিয়ো থেকে মায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প— কাউকে রেয়াত করে না। স্পষ্ট গলায়, শান্ত ভাবে তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অকালে হারিয়ে যাওয়া প্রাণগুলির হিসাব চায়। এই উদ্ধত সাহসের পুরস্কার এরা অবশ্যই পায়নি। না, ভুল হল। পুরস্কার মিলেছে কেবল এদের নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও ফেক নিউজ-এর ক্লেদোক্তিতে। প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে যে এরা অবোধ শিশু, বা বামপন্থী প্ররোচনার ফলে ভয়ঙ্কর বিপথগামী।
মার্চ মাসের ২৪ তারিখটি আমেরিকার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সে দিন আমি ওয়াশিংটন শহরে। সকালে চা খাব বলে হোটেলের ঘর থেকে রাস্তায় নেমেই দেখি, অসংখ্য কচিকাঁচা মুখ, হাতে ব্যানার, তাতে রঙিন স্লোগান, ‘যথেষ্ট হয়েছে, এ বার পরিবর্তনের সময়!’ কারও হাতের ব্যানারে লেখা, ‘এর পরের জন যেন আমি না হই!’ অনেক বাচ্চাই এত ছোট যে তারা বাবা বা মায়ের হাত না ধরে রাস্তা পেরোতে পারে না। কিন্তু কী অসম্ভব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, দৃপ্ত তাদের মুখ— সবাই সার দিয়ে চলেছে ‘মার্চ ফর আওয়ার লাইভস’ পদযাত্রায় যোগ দিতে। মানুষের ঢল ক্যাপিটল হিলের সামনে গিয়ে এক বিশাল জনস্রোতে পরিণত। আট লাখ মানুষের সমুদ্র, আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেঁচে থাকার লড়াই, বদলে দেওয়ার সদিচ্ছা, মঙ্গলের কামনা মিলে মিশে যেন এক সাক্ষাৎ পূজালোক তৈরি করেছে। টিভির পর্দায় আমরা শ্বাস বন্ধ করে দেখছি, আঠারো বছরের এমা গনজালেজ, মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছ’মিনিট কুড়ি সেকেন্ডের স্তব্ধতা পালন করছে, ঠিক যেটুকু সময়ের মধ্যে নিকোলাস ক্রজ সতেরো জন ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করে। তার মুখ কঠিন, কিন্তু গাল বেয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল। এগারো বছরের নাওমি ওয়াডলর, তার তো বয়স পুতুল খেলার, দুষ্টুমি করার— কিন্তু সে তখন মঞ্চে সারা পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘‘আমি সেই আফ্রিকান-আমেরিকান মেয়েদের কথা মনে রাখতে বলছি, যারা বন্দুক-হিংসার চোটে আজ শুধু তথ্য আর সংখ্যায় পরিণত হয়েছে।’’
দুটো কথা বলি শেষে। এক, মনে হয়, আমেরিকায় পালাবদলের দিন ঘনিয়ে আসছে। এই ছেলেমেয়েদের প্রজন্ম খুব তাড়াতাড়ি ভোট দেওয়ার বয়সে পৌঁছবে, আগামী ২-৫ বছরের মধ্যেই। যে অসম্ভব ট্র্যাজিক ঘটনার পরশমণিতে এদের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হল, আমি একটুও আশ্চর্য হব না যদি তার চোটে এরা অনেকেই সক্রিয় রাজনীতিকেই নিজেদের নেশা এবং পেশা হিসাবে বেছে নেয়। এদের ভোট কিন্তু আমেরিকার এত দিনের রাজনৈতিক পরম্পরাকে আমূল বদলে ফেলার ক্ষমতা রাখে। দুই, আমরা বড়রা, এদের কাছে ভীষণ অপরাধী। এদের আমরা সুরক্ষা দিতে পারিনি, এদের নিষ্পাপ কৈশোরকে ধ্বংস করার জন্য আমরা নানা ভাবে দায়ী। আমাদের এত প্রবল ব্যর্থতা, তবুও এরা কোন আশ্চর্য আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদেরই নতুন ভোরের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেরা ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে আসছে। আমরা পারিনি, এরা পারবে, এরাই নতুন পৃথিবী গড়ে তুলবে, এই আশাতে এখন বুক বাঁধছি।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy