Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বসন্ত তো এসে গিয়েছে কিন্তু কোকিল কই!

বছরের অন্য সময় কোকিল তা হলে কোথায় থাকে? তা হলে কি বর্ষা এলেই কোকিল মুলুক ছেড়ে পালায়, তার পরে ফিরে আসে ফাল্গুনে? লিখছেন সুদীপ জোয়ারদারবছরের অন্য সময় কোকিল তা হলে কোথায় থাকে? তা হলে কি বর্ষা এলেই কোকিল মুলুক ছেড়ে পালায়, তার পরে ফিরে আসে ফাল্গুনে? লিখছেন সুদীপ জোয়ারদার

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০৩:৪৩
Share: Save:

বসন্ত এসে গিয়েছে। ক্যালেন্ডারের হিসাব অন্তত তেমনটাই বলছে। কিন্তু ক্যালেন্ডারের হিসাবই তো সব নয়। প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে কি? এসে থাকলে, ‘নেই কেন সেই পাখি?’ নাকি আছে, ডাকছেও অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে! সৌভাগ্য, সে দিন বর্ষণক্ষান্ত রাতের শেষে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েই শুনলাম তার ডাক। একটা শিরীষ গাছে বসে ডাকছে সে-বসন্তের দূত, কোকিল। কিন্তু চারপাশে কাকেদের এমন চিৎকার যে কোকিলের সেই মধু-কূজন দুদণ্ড দাঁড়িয়ে শুনব, তার উপায় নেই। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় পড়া কবিতার লাইন দু’টি—‘কাকের কঠোর স্বর বিষ ঢালে কানে/কোকিল অখিলপ্রিয় সুমধুর তানে।’

কোকিলের মধুর তান শুধু এই বসন্তকালেরই ব্যাপার। হয়ত সেই জন্যই তার এত আদর। পৃথিবীতে ভাল জিনিস খুব কম দীর্ঘস্থায়ী হয়। কোকিলের গানও তাই। ফাল্গুন থেকে বৈশাখ কোকিলের মরসুম।

বছরের অন্য সময় কোকিল তা হলে কোথায় থাকে? তা হলে কি বর্ষা এলেই কোকিল মুলুক ছেড়ে পালায়, তার পরে ফিরে আসে ফাল্গুনে? জগদানন্দ রায় তাঁর ‘বাংলার পাখী’ তে জানিয়েছেন, ‘কোকিলরা বারোমাসই আমাদের দেশে থাকে। আষাঢ় মাস পড়িলেই তাহাদের গলার স্বর বন্ধ হইয়া যায়, তাহাদের স্ফূর্ত্তিও কমিয়া যায়। ...এই কয়টা মাস তাহারা গাছের আড়ালে লুকাইয়া অশ্বত্থ, বট প্রভৃতির ফল ও পোকামাকড় খাইয়া কাটায়।’

যে কুহু কুহু মধুর তানে বসন্তকালে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়, তা কিন্তু পুরুষ কোকিলের। স্ত্রী কোকিলের গলার স্বর ভাঙা ভাঙা, বিশ্রী। কেমন দেখতে পুরুষ কোকিল? বনফুলের ‘ডানা’তে কবি কলকে ফুলের গাছে বসা পুরুষ কোকিলটাকে দূরবিন লাগিয়ে দেখেছিলেন। ‘কুচকুচে কালো পালক। কালো গরদ যেন। সবুজ ঠোঁট। লাল চোখ। চুপ করে বসে আছে গুটিসুটি হয়ে।’ কোকিলটাকে কবির মনে হয়েছিল, ‘ধ্যানমগ্ন’, মনে হয়েছিল ‘আলোক পিপাসী অন্ধকার’। কবি কবিতাও রচনা করে ফেলেছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। ‘পিক রূপে অন্ধকার আলোর তপস্যা করে/ আলো চায় কালো/চঞ্চুতে সবুজ-স্বপ্ন, নয়নে অনল-ভাতি/বলে-আলো জ্বালো।…’

অন্য দিকে স্ত্রী কোকিলের গায়ের রং ‘বাংলার পাখী’ অনুযায়ী, ‘কতকটা খয়েরি, তার উপর সাদা ডোরা ও ছিটা-ফোঁটা থাকে।’ স্বভাবে স্ত্রী কোকিলরা খুবই লাজুক। তবে ডিম পাড়ার সময়ে মরিয়া হয়ে যায়। জগদানন্দ রায়ের বর্ণনা অনুযায়ী, এ সময় স্বামী স্ত্রীর যৌথ প্রয়াস বেশ মজাদার এবং কতকটা নির্মমও। আসলে কাকের কাছে তো জগতের সব কিছুই অপছন্দের। আর সব কিছুর দিকেই তার তেড়ে যাওয়া স্বভাব। কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ার সময় কাকের এই স্বভাবটাকেই কাজে লাগায়। কাকের বাসার সামনে এসে পুরুষ কোকিল ‘কু-উ’ ‘কু-উ’ করে ডাকতে থাকে। কাক বাসা ছেড়ে পুরুষ কোকিলের দিকে তেড়ে যায়। পুরুষ কোকিলটি তখন পালাবার ভান করে কাককে পিছনে ছুটিয়ে বাসা থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে যায়। এতক্ষণ গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্ত্রী কোকিলটি এ বার বের হয়ে আসে। তারপর তাড়াতাড়ি কাকের বাসায় ঢুকে গিয়ে সে ডিম পাড়ে। এ সময় কাকের ডিমের জন্য তার নিজের ডিমের স্থান সঙ্কুলান না হলে, কাকের ডিম বাসা থেকে ফেলে দিতেও সে দ্বিধা করে না।

বসন্ত কবিদের কাছে খুবই প্রিয় ঋতু। রবীন্দ্রনাথের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর অনেক কবিতায়, গানে বসন্তের অনুষঙ্গ হিসাবে কোকিলও এসেছে। তবে সর্বত্রই যে সে বন্দিত হয়েছে তা কিন্তু নয়। ‘কুহরি উঠিছে কাননে কোকিল’ (‘ফুলবালা গাথা’/ ‘শৈশব সঙ্গীত’) যেমন আছে, তেমনই আছে, ‘জারুলের শাখায় অদূরে/কোকিল ভাঙিছে গলা একঘেয়ে প্রলাপের সুরে’(‘অপঘাত’/ ‘সানাই’)। তবে কোকিলের কুহু ডাক নিয়ে আমাদের সকলের মনের কথাটি রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন ‘মানসী’র ‘কুহুধ্বনি’ কবিতায়— ‘কেহ বসে গৃহমাঝে, কেহ বা চলিছে কাজে/ কেহ শোনে, কেহ নাহি শোনে/তবুও সে কী মায়ায়,ওই ধ্বনি থেকে যায় বিশ্বব্যাপী মানবের মনে।’

আর নজরুল তো ‘বাসন্তিকা’ নামে একটি একাঙ্ক নাটকই লিখেছিলেন যেখানে কোকিল একটি চরিত্র। হৃদয়রাজ্যের রাজা ফাল্গুনীর সে দূত। নজরুলের অন্য অনেক কবিতা, গানে বসন্ত এসেছে। নজরুলের বসন্তে যতটা বুলবুল আছে, ততটা অবশ্য কোকিল নেই। তবে যেটুকু আছে তা অনুপম। যেমন, ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া কুহরিল মহুয়া বনে’ গানটি।

‘মৈথিল কোকিল’ বলা হয় বিদ্যাপতিকে। বিদ্যাপতির বসন্ত ঋতুর প্রেক্ষাপটে অনেক পদ রয়েছে। মিলনের, বিরহের। স্বাভাবিক ভাবেই বসন্তের প্রধান অনুষঙ্গ কোকিলও সেখানে উপস্থিত। ‘সোই কোকিল অব লাখ লাখ ডাকউ /লাখ উদয় করু চন্দা’, ‘আরে,কুসুমিত কানন কোকিলনাদ।/মুনি হুক মানস উপজু বিষাদ’ ইত্যাদি।

বঙ্কিমচন্দ্র বসন্তের কোকিলকে নানা ভাবে দেখেছেন। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ এ বসন্তের কোকিল রূপক। এখানে কমলাকান্ত ওরফে বঙ্কিমচন্দ্র বিঁধতে চেয়েছেন মনুষ্য সমাজের কোকিল স্বভাবের লোকেদের। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসে বসন্তের কোকিল কিন্তু বসন্তেরই দূত। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (প্রথম খণ্ড)এর কোনও পরিচ্ছেদের কোনও শিরোনাম দেননি বঙ্কিম। যদি দিতেন তবে ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের শিরোনাম হয়তো হত ‘বসন্তের কোকিল’ বা ‘কুহুধ্বনি’ জাতীয় কিছু। কেননা এই পরিচ্ছেদে সে-ই সব। তার কুহু কুহু রবই এই পরিচ্ছেদের আবহসঙ্গীত। কোকিলের কুহু কুহু ডাক শুনেই রোহিণীর মনে হয়—‘এ জীবন বৃথা গেল-সুখের মাত্রা পুরিল না।’ দুষ্টু কোকিল তার কুহু স্বরে এমনই জাল বিস্তার করে যে কলসি জলে ভাসিয়ে কাঁদতেও বসে রোহিণী।

বিভূতিভূষণের লেখক মানসিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যে এক সময় দু’ধরনের লেখকের কথা বলা হয়েছিল। কাকপন্থী বা জ্ঞানমার্গীয়, কোকিল বৃত্তের লেখক বা আস্বাদনপন্থী। বিভূতিভূষণকে বলা হয়েছিল কোকিল বৃত্তের লেখক। কেননা জীবনকে উপভোগ বা আস্বাদন করবার মানসিকতা তাঁর লেখায় রয়েছে।

কোকিল কিন্তু ময়না, টিয়ার মতো খাঁচায় পোষা যায়। আগে তো অনেকেই পুষতেন। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে মহেন্দ্র আশার ঘরের বারান্দায় পোষা কোকিলের খাঁচা ছিল। আশার মাসি এবং মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, চাকরবাকরেরা নানা অজুহাতে ছুটি নিতে থাকে। কোকিলটি দেখভালের অভাবে মারা যায়।

আমাদের সাহিত্যে কোকিল এ ভাবেই জায়গা করে নিয়েছে অনেকটা। প্রকৃতিতে কিন্তু কোকিলের জায়গা কমে আসছে। এখন বসন্তে সে ভাবে কোকিলের ডাক আর শোনা যায় কোথায়? কারণ, নতুন কিছু নয়—দূষণ। মান্না দে সেই কবে গেয়েছিলেন—‘ও কোকিলা তোরে শুধাই রে…।’ আজও সে গান শুনতে বেশ লাগে। কিন্তু কোকিলের সময়ে, যদি কোকিলের দেখা সে ভাবে না পাওয়া যায়, তবে গানের প্রশ্নটা তো পাক খেয়েই ফিরবে!

শিক্ষক,ভগবানগোলা হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cuckoo Spring
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE