Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

কোনও জায়গাই তা হলে আর সেফ না

সে দিনও একটা ধারণা বাতাসে ঘুরত, সাধারণত পর্যটনকেন্দ্র বাদ দিয়েই জঙ্গি হামলা হয়। যাতে পর্যটকদের ক্ষতি ও আখেরে পর্যটনশিল্পেরই ক্ষতি, এমন কাণ্ড সশস্ত্র চরমপন্থীরা করে না। কিন্তু সে ধারণা আর মিলছে না।সে দিনও একটা ধারণা বাতাসে ঘুরত, সাধারণত পর্যটনকেন্দ্র বাদ দিয়েই জঙ্গি হামলা হয়। যাতে পর্যটকদের ক্ষতি ও আখেরে পর্যটনশিল্পেরই ক্ষতি, এমন কাণ্ড সশস্ত্র চরমপন্থীরা করে না। কিন্তু সে ধারণা আর মিলছে না।

অধরা। ডাল লেক, শ্রীনগর। সেপ্টেম্বর ২০১৬। ছবি: রয়টার্স

অধরা। ডাল লেক, শ্রীনগর। সেপ্টেম্বর ২০১৬। ছবি: রয়টার্স

সুরবেক বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

তিরিশ বছর পর ‘আবার অরণ্যে’ বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করার সময়ে অসীম তাঁর বন্ধুদের বলেছিলেন, ‘না রে পালামৌয়ে যাওয়া চলবে না। সবাই বলছে, পালামৌ এখন আর সেফ না।’ অতএব ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র বেতলায় না গিয়ে অসীম, সঞ্জয়, হরি সপরিবার গেলেন ডুয়ার্সে। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল, আচমকা নিখোঁজ হয়ে যায় অসীমের মেয়ে অমৃতা বা আম্মু। পরে মুক্তিপণ চেয়ে চিঠিও পান অসীম। আর তখন লেখক-বন্ধু সঞ্জয়ের তীব্র প্রশ্নের মুখে পড়েন। ‘তুই তো বলেছিলি বেতলার ফরেস্ট নাকি সেফ নয়!’ এর পর অসীমের উক্তি, ‘আমাদের মতো বাবুদের পক্ষে কোনও জায়গাই আর সেফ নয়।’

এ বার পুজোর ছুটিতে কাশ্মীর ভ্রমণ বাতিল করতে হয়েছে অসংখ্য পর্যটককে। কারণ, পরিস্থিতি বলছে, কাশ্মীর এখন নিরাপদ নয়। শুধু সীমান্তে অশান্তি তো নয়, শহরেও গণ্ডগোল, হিংসা, যে কোনও মুহূর্তে কার্ফু। লেক গার্ডেন্সের শৈবাল গঙ্গোপাধ্যায় তবু ভেবেছিলেন, যাবেন। অতগুলো টাকা দিয়ে প্লেনের টিকিট কাটা, হোটেল বুক করা, গাড়ি ভাড়া নেওয়া— সব বাতিল করতে মন চায়নি। কিন্তু একাধিক হোটেলের মালিক ফোনে বলে দেন, ‘দয়া করে আসবেন না। কিছু হলে আমাদের কোনও দায়িত্ব নেই। উপত্যকা এখন পর্যটকদের জন্য সেফ নয়।’

অন্য সব জায়গা সেফ তো? দেশে ও বিদেশে?

জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর একটি নথি থেকে অক্টোবর মাসে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশে ফের হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা এবং এ বার তাদের ‘টার্গেট’ পর্যটকেরাও!

পর্যটনের দেশ তাইল্যান্ডে গত ১০ অগস্ট রাত থেকে ১২ অগস্ট সকাল পর্যন্ত মোট ১৩টি বিস্ফোরণ, নিহত ৪, আহত বহু মানুষ। যে সব জায়গায় বিস্ফোরণ হয়েছে, তার তালিকায় আছে সমুদ্র সৈকতের জন্য গোটা দুনিয়ায় জনপ্রিয় ফুকেত এবং রিসর্ট শহর হুয়া হিন।

এই সে দিনও একটা ধারণা বাতাসে ঘুরত, সাধারণত পর্যটনকেন্দ্র বাদ দিয়েই জঙ্গি হামলা হয়। যাতে পর্যটকদের ক্ষতি ও আখেরে পর্যটনশিল্পেরই ক্ষতি, এমন কাণ্ড সশস্ত্র চরমপন্থীরা করে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখন ক্রমশ সেটা ‘মিথ’-এ পরিণত। ফুকেত আর হুয়া হিনে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বিদেশি পর্যটকদের লক্ষ করেই। তাইল্যান্ড দেশটার মানুষের কাছে কয়েক দশক ধরে করে পর্যটকই লক্ষ্মী। সেই পর্যটকরাই এ বার হামলার শিকার হচ্ছেন। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ থেকেই দল কে দল ভ্রমণপিপাসু তাইল্যান্ড যাওয়া বাতিল করছেন। সরকারি হিসেবেই সে দেশে চলতি মরসুমে দু’লক্ষ পর্যটক কম আসার আশঙ্কা। আর্থিক ক্ষতি গিয়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ৩০ কোটি ডলার।

জুনের তৃতীয় সপ্তাহে ব্যাঙ্কক থেকে পাটায়া পৌঁছে আমরা সবাই মুগ্ধ। আমার বন্ধু ও তাঁর স্ত্রী-কন্যার ইউরোপ ঘোরা। বন্ধুর কন্যা বলল, পাটায়ায় এসে তার বার বার ফ্রান্সের নিস-এর কথা মনে পড়ছে, তবে নিস আরও সুন্দর।

ওই কথা বলার পরে মাস পেরনোর আগেই, ১৪ জুলাই ফ্রান্সের সেই শহর, পর্যটনের জন্য বিখ্যাত, সমুদ্র ঘেঁষা নিসেই বাস্তিল ডে উদযাপনের রাতে ১৯ টন ওজনের একটা ট্রাক পিষে দিল ১০ শিশু-সহ ৮৪ জনকে। হামলার কৃতিত্ব দাবি করল আইএস। নিস কোনও নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, লন্ডন, প্যারিস নয়। পর্যটনের জন্যই তার মাহাত্ম্য। এক দিকে ইতিহাসের চিহ্ন আর অন্য দিকে কেনাকাটা করার গমগমে সব জায়গা, হরেক কিসিমের খাবারের রেস্তোরাঁ। সেই নিসকেও ছাড়ল না জঙ্গিরা। আসলে নিস শহরের থেকে বহু তরুণ সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের হয়ে যুদ্ধ করছে। হামলা চালানোর পক্ষে নিস নাকি সেই জন্যই সুবিধেজনক।

চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত বাঙালিও অধুনা পয়সা জমিয়ে, টাকা ধার নিয়ে, এফডি ভেঙে, ইএমআই দিয়ে চুটিয়ে ইওরোপ ভ্রমণে যান। কিন্তু ট্যুর অপারেটরদের সম্প্রতি আকছার শুনতে হচ্ছে, ‘ইউরোপে তো আইএস হামলা চালাচ্ছে, ওখানে গেলে মারা পড়ব, একটু সেফ জায়গা কিছু দেখুন।’ অসীম আবারও বলবে, কোনও জায়গাই আর সেফ নয়।

দূরের কথা ছেড়ে কাছে আসা যাক এ বার। কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-দক্ষিণ সর্বত্র ছিল আতঙ্ক। ২০১১-র ফেব্রুয়ারি। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে যাওয়ার কথা ডুয়ার্সের সামসিংয়ে। পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের বাংলোয় দু’রাতের বুকিং ছিল। কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার আগের দিন গোটা বাংলোটাই পুড়িয়ে ছাই করে দিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থকেরা। রাগ তাদের রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। তাই, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করো। পর্যটকেরা তাতে ভয় পেয়ে না এলে, পর্যটন-নির্ভর ব্যবসায়ীরা ভাতে মরলে কিছু যায় আসে না। আগুনের হলকা ছড়িয়ে রাগটা দেখানোই আসল।

পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের দুয়ারসিনিতে একটা সময়ে পর্যটন ছিল রমরমা। হঠাৎই এক দিন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেখানে নির্মীয়মাণ সরকারি বাংলো ওড়াল মাওবাদীরা। তার পর থেকে বছরের পর বছর দুয়ারসিনিমুখো হননি পর্যটকরা। মাওবাদীরা সেখানে বন উন্নয়ন নিগমের একটা কটেজেও হাত দেয়নি। কিন্তু পর্যটক না পেতে পেতে ওই নদীর কাছে, জঙ্গলের ধারে ওই কটেজগুলোই ভগ্নস্তূপে পরিণত। জঙ্গলমহল এখন শান্ত, তবে দুয়ারসিনিতে পর্যটকেরা চাইলেও থাকার জায়গা নেই। আর নতুন করে গড়ে ওঠেনি।

দুয়ারসিনি পেরোলেই ঝাড়খণ্ডের গালুডি। সেখানে পর্যটক দুয়ারসিনির তুলনায় বেশি যাচ্ছেন। গালুডি ও নিকটবর্তী ঘাটশিলায় বহু থাকার জায়গা আছে। অথচ রাজ্য হিসেবে ঝাড়খণ্ডে মাওবাদী প্রভাব, কার্যকলাপ ও হিংসার ঘটনা অত্যন্ত বেশি। বছর পাঁচ-ছয় আগে ঘাটশিলার বুরুডি লেকের কাছে নিরাপত্তারক্ষীদের একটি গাড়ি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছিল মাওবাদীরা। ওই ঘটনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এক অটো রিকশা চালক বলছিলেন, ‘বুরুডিতে যে সব পর্যটক আগেই পৌঁছেছিলেন, ওই তল্লাট ছেড়ে তাঁদের না বেরোনো পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করেছিল। তবে নতুন করে আর কোনও পর্যটক বোঝাই গাড়ি বা অটো রিকশা ঢুকতে দেয়নি। বলেছিল, ‘এখন ঢোকা যাবে না, অসুবিধে আছে।’ তার পরেই বিস্ফোরণ ঘটায় ওরা।’

তবে সব চরমপন্থীই সব সময়ে অত পর্যটক-বান্ধব হবেন, তার কোনও মানে নেই। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র সেই বেতলার জঙ্গলও ঝাড়খণ্ডে। সপরিবার সেখানে বেড়াতে যাওয়া কি এখন নিরাপদ? এক সাংবাদিক-বন্ধুর জবাব, ‘এমনিতে ভয় নেই, তবে মাওবাদীদের নামে তো অনেক সমাজবিরোধী অপরাধ করছে, সংগঠনের মধ্যে ওই সব উপাদান ঢুকে গিয়েছে। ওরা কখন কী করবে, কেউ বলতে পারে না।’

কোনও জায়গাই আর সেফ নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Terrorism No Longer Safe Surbek Biswas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE