কত যে গল্পে কবিতায় গানে আজানের ধ্বনির কথা পাই! কাকভোরে কিংবা আকাশ ভরা তারার নীচে দূরাগত আজানের সুরে মুগ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা বোধ হয় আমার মতো অনেকেরই আছে। আবার মাইক্রোফোন বাহিত কর্কশ বেসুরো আজানের উপদ্রবও আমাদেরই সইতে হয় হামেশা। এ সব আমাদের দৈনন্দিনতায় মিশে থাকে, বিশেষ হয়ে দেখা দেয় না বড় একটা। এরই মধ্যে হঠাৎ আজানে লাউডস্পিকার ব্যবহারের বিরুদ্ধে গায়ক সোনু নিগমের মন্তব্য ঘিরে হাওয়া গরম হয়ে উঠতে দেখা গেল।
আজানে মাইক ব্যবহারের বিরুদ্ধে গায়ক সোনু নিগমের মন্তব্য এবং তার প্রতিক্রিয়ায় কলকাতার এক তৃণমূলপন্থী সংখ্যালঘু সংগঠনের নেতা জনৈক শাহ ফতেহ আলি সোনু নিগমের গলায় জুতোর মালা ঝুলিয়ে মাথা নেড়া করে প্রকাশ্যে ঘোরানোর ফতোয়া জারি করেন। তা শুনে সোনু নিজেই মাথা মুড়িয়ে ফেলেন। সোনু অবশ্য পরে একই সঙ্গে মন্দির এবং গুরুদ্বারে যথেচ্ছ মাইকের দৌরাত্ম্যেরও বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করলেন। কিন্তু তাঁর প্রথম বক্তব্যই বাকি সব মন্তব্যকে পিছনে ফেলে দিল। আজানে মাইক বন্ধ করার পুরনো দাবি এবং পুরনো বিতর্কটা বেশ জোরদার হয়ে উঠল। মহারাষ্ট্রের হিন্দু জাগৃতি সমিতি সঙ্গে সঙ্গে সেই দাবি নিয়ে কোমর বেঁধে আসরে নেমে পড়ল। তাদের অতিরিক্ত দাবি দাঁড়াল, অন্তত ফজরের (ভোরের নামাজ) আজানে কোনও ভাবেই মাইক ব্যবহার চলবে না, দেশের মানুষের শান্তিতে ঘুমনোর অধিকারের কথা ভেবে।
এ রাজ্যে বিভিন্ন জেলায় গত কয়েক বছর ধরে প্রায়ই সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটতে দেখা গিয়েছে। আমাদের সামাজিক জোরের জায়গাগুলো আলগা করে দিয়ে মাঝেমাঝেই এখানে সেখানে সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন জ্বলে উঠছে। তৃণমূল কংগ্রেস সংখ্যালঘুর প্রতি মনোযোগ দেবার নাম করে মুসলিম কট্টরবাদীদের যে ভাবে তোষণ করেছে, সেই খাল দিয়ে প্রবল বেগে ঢুকে পড়েছে হিন্দুত্ববাদীর দল। গোরক্ষার নামে বাড়াবাড়ি, মারামারি তো চলছিলই, আজানের মাইক তাতে আরও জোরালো ইন্ধন জোগাল। মাইক ব্যবহার কতটা সঙ্গত, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু যেটা উদ্বেগের তা হল, এই বিতর্কের সূত্র ধরে আমাদের চার পাশে হিন্দুত্ববাদী মনগুলো আবার জেগে উঠছে। অনেকেই ভেবে দেখছেন না যে, কেবল মসজিদের মিনার থেকে নয়, ঘুমতাড়ানো মাইকের আওয়াজ মন্দির এবং গুরুদ্বার থেকেও হয়। কারণ, ধর্ম তার সীমার মধ্যে নীরব সাধনায় সীমাবদ্ধ থাকতে জানে না। যে কোনও সংগঠিত ধর্মই সরবে নিজের অস্তিত্ব এবং ক্ষমতা জানান দিতে তায়। তার কাছে অন্যরা যে অপর, কথাটা সে অন্যদের এবং নিজেদের বার বার মনে করিয়ে দিতে চায়। তাই তার ধর্মাচরণে এত জাহির করার বাড়াবাড়ি, এত বেশি শব্দ। ছোট বড় সব রকমের পুজোর মন্ত্রপাঠে লাউডস্পিকার থাকেই। হিন্দুদের পুজোপাঠ এমনিতেই বেশ জোরালো, শব্দময়। মুসলমানদের মধ্যেও আজানে মাইক ব্যবহার বাড়ছে, বাড়ছে পাড়ায় পাড়ায় রাতভর গোটা গ্রাম জাগিয়ে জলসা (ধর্মীয় প্রবচনের আয়োজন)। কিন্তু দাবি তোলার সময়ে এই সামগ্রিক সমস্যার কথা বলতে আমরা ভুলে যাচ্ছি। উল্টে এটাকে একটা ‘মুসলিম সমস্যা’ হিসেবে দেখছি। তারা কেন সীমা লঙ্ঘন করবে! সংখ্যালঘুর ধর্ম বা সংস্কৃতির আওয়াজ কেন এত বেশি শোনা যাবে, দেখা যাবে! হিন্দুত্ববাদের যুক্তিটা বহুশ্রুত: আমাদের প্রতিবেশী দেশে সংখ্যালঘুরা যে ভাবে রয়েছে, সে ভাবেই ভারতের মুসলিমরা কেন থাকবে না। নানা ধর্মের মানুষ যেখানে পাশাপাশি বাস করে, সেখানে মন্দির এবং মসজিদের মাইকের আওয়াজ নিয়েও মাঝেমধ্যে গণ্ডগোল বাধে। এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিবাদ, এমনকী দাঙ্গাও কম হয়নি। উত্তরপ্রদেশে গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে যতগুলো সাম্প্রদায়িক বিবাদ হয়েছে তার বেশির ভাগের উৎস ধর্মস্থানে মাইকের চিৎকার। অথচ ইতিমধ্যে মন্দিরে বা পুজোয় লাউডস্পিকার বন্ধ করা নিয়ে হিন্দুদের কোনও উদ্যোগ বা আলোচনা শুনেছি কি?
আজানে (নামাজের জন্য আহ্বান) লাউডস্পিকারের ব্যবহার জায়েজ না নাজায়েজ, তাই নিয়ে মুসলমান সমাজে আলেমদের মধ্যে আজও মতভেদ রয়েছে। বিরোধীদের যুক্তি, মানুষের কথা তড়িৎবাহিত হয়ে মাইকের মাধ্যমে যখন শোনা যায়, তখন সেটা মানুষের প্রকৃত কণ্ঠস্বর নয়, যন্ত্রের আওয়াজ। আলেমদের সে আপত্তি ধোপে টেকেনি। কলকাতার প্রায় প্রত্যেকটি মুসলিম মহল্লায় এমনিতেই একাধিক মসজিদ তাদের মাইক থাকা সত্ত্বেও সরকারি উদ্যোগে বস্তির গলিতে গলিতে স্থায়ী মাইক লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে আজান সম্প্রচারের জন্য। ঘরের মধ্যে কানের কাছে সেই আওয়াজ যে কতটা অসুবিধাজনক, তার একটা মর্মছোঁওয়া কাহিনি মীরাতুন নাহারের ‘আজান ও মেহেরজান’ ছোটগল্প। নেতা, মৌলানা, পার্টি অফিসে আর্জি জানিয়ে সুরাহা পাননি প্রৌঢ়া বিধবা মেহেরজান। শেষপর্যন্ত ‘আল্লা মেহেরবান! বিশ্বপালক তিনি মেহেরজানকে কৃপা করেছেন! কানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া মাইকের আজান-ধ্বনি শোনার যন্ত্রণা আর তাকে পেতে হয় না। বস্তুত শব্দজগতের কঠিন ও মধুর কোনও ধ্বনি তার কানে আর পৌঁছয় না।’ মীরাতুন নাহারের গল্প মসজিদ বা মন্দিরের সেই কর্তাদের হৃদয় পরিবর্তন করতে পারবে না, যাঁরা তাঁদের উপাসনার ধ্বনি মানুষের মাথায় গজাল মেরে ঢোকানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। ‘অপ্রিয়’ শব্দগুলো প্রযুক্তি বহুগুণ করে পৌঁছে দিচ্ছে আমাদের কানের গোড়ায়।
সেকুলারপন্থীরা মনে করেন, কোনও ধর্মেরই অধিকার নেই হট্টগোল করে অন্যকে বিরক্ত করার— সে আজানই হোক বা পুজোপাঠ। ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং অন্তরের ভিতরকার বিষয়। কিন্তু ধর্ম যেখানে সর্বজনীন, চিৎকৃত উদ্যাপনেই যে চরিতার্থ হয়, সেখানে এই সব যুক্তি ছেঁদো এবং বাতিল। ব্রাহ্ম ধর্ম আর খ্রিস্টানদের কিছু উপসম্প্রদায় বাদ দিলে আধুনিক ধর্ম কোনও কালেই ব্যক্তিগত মগ্নতার বিষয় ছিল না। ধর্মের শব্দ, দৃশ্য, বর্ণ এবং গন্ধের মধ্যে অবগাহন করে তবেই ধর্মের সদস্য হতে পারবে তুমি। হিন্দুর পশু বলিই হোক বা মুসলমানের কুরবানি— একটি প্রাণীর নৃশংস হত্যা এবং অবাধ রক্তপাত সক্রিয় ভাবে প্রত্যক্ষ করলে তবেই ধর্মের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা। উগ্রতার চাপে ধর্মের যৌথ যাপনের জায়গাগুলোর মতোই ধর্মসম্পর্কহীন লৌকিক সংস্কৃতির গণপরিসরগুলোও খাটো হয়ে আসছে।
তাই আইন থাকা সত্ত্বেও শব্দের অত্যাচার কমে না। রাজ্যের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনে রয়েছে, বসত এলাকায় সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবেল, রাত্রে ৪৫ ডেসিবেলের অধিক আওয়াজ দণ্ডনীয় অপরাধ। আওয়াজের এই নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা গেলে একটা জাতীয় উপকার হত। পরিসংখ্যান বলছে, বধিরতার তালিকায় ভারত গোড়ার দিকে। এ দেশে ৭.৬% মানুষ আর ২% শিশু অতিশব্দের অত্যাচারে বধির। নৈঃশব্দ্যের অধিকার ভারতের মতো ধর্ম-রাজনীতির দেশে স্বীকৃতি পায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy