Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
National news

অঙ্কে পাকা, রাজনীতিতে কি কাঁচা?

যে ভাষায় বিজেপি তার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে, যে বিষয় নিয়ে বিজেপি আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছে, তা বিজেপি নেতৃত্বের রাজনৈতিক বোধ নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।

সংসদ ভবনের ফাইল চিত্র।

সংসদ ভবনের ফাইল চিত্র।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

আত্মবিশ্বাস প্রমাণ করতে কটাক্ষ ছুড়ছে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে যে অনাস্থা প্রস্তাব সংসদে পেশ হয়েছে, সে প্রস্তাবকে পরাস্ত করার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী বিজেপি। অত্যন্ত স্বাভাবিক এ প্রত্যয়, লোকসভায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র সংখ্যাধিক্য নিয়ে কোনও প্রশ্নই নেই। প্রশ্ন হল প্রত্যয়ের প্রকাশ ভঙ্গিটা নিয়ে। যে ভাষায় বিজেপি তার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে, যে বিষয় নিয়ে বিজেপি আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছে, তা বিজেপি নেতৃত্বের রাজনৈতিক বোধ নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।

লোকসভার আসন বিন্যাস এই মুহূর্তে যে রকম, তাতে বিজেপি একাই মন্ত্রিসভাকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। এনডিএ শরিকরা সঙ্গে থাকলে তো অনাস্থা প্রস্তাবের পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশই নেই। তাই কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অনন্ত কুমার কটাক্ষ ছুড়েছেন, সনিয়া গাঁধী অঙ্কে কাঁচা বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

ইউপিএ চেয়ারপার্সন কি সত্যিই অঙ্কে কাঁচা? গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যখন এমন কথা বলছেন, তখন বিষয়টা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু মন্ত্রী নিজে যে গণতান্ত্রিক দেওয়ালের রাজনৈতিক লিখন পড়ার কাজে কাঁচা, তা নিয়ে কোনও তর্ক থাকতে পারে না।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

সংসদের বিপুল সংখ্যাধিক্য এবং অনেকগুলি নির্বাচনী সাফল্যের গর্বেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার গত ৪ বছর ধরে বিরোধীদের যাবতীয় মতামতকে নস্যাৎ করার নীতি নিয়েই এগিয়েছে মোটের উপর। বিরোধীতার পরিসরকে ঠেসে ধরার যে প্রবণতা ধরা দিয়েছে মোদী সরকারের চলনে-বলনে বারবার, তা গোটা বিরোধী পক্ষকেই জাতীয় রাজনীতিতে অস্তিস্বের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছিল। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ যে বিরোধী ঐক্য ত্বরান্বিত করবে, তা হয়ত বিজেপি নেতৃত্ব বুঝতে পারেননি অথবা ঐক্যের সম্ভাবনাকে তাঁরা গুরুত্ব দেননি। দেশের প্রধান শাসকদলের এই স্বদম্ভ আচরণ দুটি ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রথমত, পারস্পরিক ফারাক এবং স্বার্থের সংঘাত সরিয়ে রেখে প্রায় গোটা বিরোধী শিবিরকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয়ত, এনডিএ-র অভ্যন্তরীণ গ্রন্থিগুলিকে ক্রমেই শিথিল এবং ছিন্নভিন্ন করেছে। ফল কী হয়েছে? সংসদের ভিতরে তো বটেই, সংসদের বাইরেও অধিকাংশ বিরোধী দল হাতে হাত রেখে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে তীব্র বিরোধিতা ও সমালোচনা শুরু করেছে। আর সেই বিরোধীতার মোকাবিলা মূলত বিজেপি-কে একাই করতে হচ্ছে। প্রায় কোনও এনডিএ শরিক বিজেপির হয়ে মুখ খুলছে না। শিবসেনা, জেডিইউ, এলজেপি, আরএলএসপি-সহ একাধিক শরিক বরং উঁচু বা নিঁচু স্বরে বিরোধীদের সঙ্গেই সুর মেলাচ্ছে।

আরও পড়ুন: সংখ্যা রাখতে হিমশিম, হাতজোড় করে শরিক ও ‘বন্ধু’ নেতাদের অনুরোধ অমিতের!

এই অনাস্থাটাই আসলে সংখ্যাধিক্য নিয়ে সংশয়ের প্রকাশের অনাস্থা নয়। এই অনাস্থা অনেক বেশি প্রতীকী, এ হল নরেন্দ্র মোদীর রাজনীতির প্রতি অনাস্থা।

লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব বড়সড় ব্যবধানে পরাস্ত হলে আশ্চর্য, বিস্মৃত, দুঃখিত বা উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ সরল পাটিগণিত অনুসারে তেমনই হওযার কথা। কিন্তু এই অনাস্থা প্রস্তাবকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক রসায়নটা কী চেহারা নেয়, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিরোধী শিবির থেকে সার্বিক ঐক্যের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। সে ঐক্য কতটা সংঘটিত হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ওডিশার বিজেডি বা তামিলনাড়ুর এডিএমকে ভোটাভুটিতে বিরত থাকতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু উল্টো ছবিও তৈরি হচ্ছে। অন্ধ্রের রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ যে দল, সেই তেলুগু দেশমের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করতে রাহুল গাঁধীরা খুবই সক্রিয় হয়েছেন। অনাস্থা আনার আগে তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। অনাস্থা নিয়ে যে দিন সংসদে ভোটাভুটি হওয়ার কথা, তার পরের দিনই কলকাতায় তৃণমূলের শহিদ স্মরণ সমাবেশ। তা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছেন, ২০ জুলাই তৃণমূল সাংসদরা লোকসভায় হাজির থাকবেন এবং ভোটাভুটিতে অংশ নেবেন। অর্থাৎ ছোটখাটো সঙ্ঘাতের ক্ষেত্র সরিয়ে রেখে বৃহত্তর স্বার্থে গোটা দেশে মোদী বিরোধী জোট শক্তিশালী হচ্ছে— এ রকম একটা বার্তা লোকসভা থেকে গোটা দেশের সামনে উপস্থিত করার চেষ্টা চলছে।

এর পাল্টা বার্তা কী হওয়া উচিত ছিল? এর পাল্টা বার্তা হওয়া উচিত ছিল, বারবার ঐক্যবদ্ধ এনডিএ-র ছবি তুলে ধরা। এর পাল্টা বার্তা হওয়া উচিত ছিল, বারবার সরকারের সেই সব নীতি ও পদক্ষেপের পক্ষে জোরদার সওয়াল করা বা যা বিরোধীদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে। এর পাল্টা বার্তা হওয়া উচিত ছিল, বারবার নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জ্ঞাপনের কথা জোর দিয়ে বলা। বিজেপি সে পথে না হেঁটে নিজেদের গাণিতিক পরিপক্কতা নিয়ে আত্মবিশ্বাস দেখাতে লাগল। সেখানেই নৈতিক দুর্বলতার ধারণা তৈরি হয়।

অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে লোকসভায় বিশদ বিতর্ক হবে। সে বিতর্কে সাম্প্রদায়িকতা, অসহিষ্ণুতা, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টা, ভ্রান্ত অর্থনৈতিক পদক্ষেপ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না করা— এমন অজস্র অভিযোগে সবকটি বিরোধী দল তীব্র স্বরে বিঁধবে নরেন্দ্র মোদীকে। তার পরে মোদী নিজেই হয়ত সে সবের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবেন। সংসদের বাইরে অর্থাৎ গোটা দেশের জনপরিসরে মোদীর সেই জবাবী বার্তার জন্য পটভূমি তৈরি করা কি উচিত ছিল না বিজেপির? সংখ্যার দম্ভে সে বোধও লোপ পেল সম্ভবত। জানা অঙ্কের উত্তর মেলানোতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখল বিজেপি। বিপজ্জনক হয়ে উঠতে থাকা সমীকরণের পাল্টা জবাব খোঁজার পথে হাঁটতে চাইল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE