মুদ্রারহিতকরণের এক মাস কাটিয়ে এসে অর্থমন্ত্রীর মুখে কালো টাকার উল্লেখই নেই আর। ছবি: সংগৃহীত।
ছিল কালো টাকার বিরুদ্ধে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। কিন্তু হয়ে গেল ভারতকে নগদহীন অর্থনীতি করে তোলার যুদ্ধ।
মুদ্রারহিতকরণের এক মাস কাটিয়ে এসে অর্থমন্ত্রীর মুখে কালো টাকার উল্লেখই নেই আর। কী বললেন অরুণ জেটলি? বললেন, নগদরহিত লেনদেনে অভ্যস্ত হতে হবে ভারতকে। বোঝাতে চাইলেন, নগদে লেনদেন করা মোটেই ভাল নয়। ঘোষণা করলেন, চটপট নগদহীন ভাবে দিন কাটাতে শিখে নিলে সরকার কী কী সুবিধা দেবে।
কোন লক্ষ্যে বাজার থেকে পাঁচশো আর হাজারের নোট তুলে নেওয়া হয়েছিল তা হলে? সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে গোটা ভারত এখন। এক মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর এক আকস্মিক ঘোষণা আতান্তরে ফেলেছে গোটা দেশকে। সে আতান্তর এখনও বহমান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এ পদক্ষেপ বর্বরের ধনক্ষয় আর পীড়িতের ক্লেশ লাঘবের লক্ষ্যেই। বৃহত্তর সেই উদ্দেশ্য সাধনের স্বার্থে আতান্তর মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন দেশবাসী। কিন্তু মাস ঘুরতেই মনে হল, লক্ষ্যটা বদলে গিয়েছে সরকারের। তিরিশটা দিনে কালো টাকার সর্বনাশ কতখানি হল, সে নিয়ে উচ্চবাচ্য আর নেই। নাগরিকের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ছিল, নগদের সঙ্কট পঞ্চাশ দিন মেনে নিন, তাতেই দুষ্ট দমে যাবে, শোষণমুক্তি হবে, নতুন দিন আসবে, শিষ্টের পালন হবে। শিষ্ট নাগরিক সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে নগদ বিভ্রাটের সঙ্গে তিরিশ দিন যুঝে নেওয়ার পর সরকার ফের মুখ খুলল। কিন্তু দুষ্ট কতটা দমেছে তা জানাল না। বরং বলল, নগদ ভাল নয় মোটেই। নগদ ছেড়ে ডিজিটাল হয়ে যাওয়াই ভাল।
মুদ্রারহিতকরণের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়া মাত্রই সুবিশাল বিজ্ঞাপনে ই-ওয়ালেট সংস্থাগুলি স্বাগত জানিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ‘বিচক্ষণতা’কে। মাস ঘুরতেই বোঝা গেল, ই-ওয়ালেট সংস্থাগুলিও কম বিচক্ষণ নয়। কারণ ই-ওয়ালেট, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, নেট ব্যাঙ্কিং-ই গোটা প্রক্রিয়ার কেন্দ্রস্থলে চলে এসেছে মাত্র তিরিশ দিনে।
সরকার যে হেতু কালো টাকা প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল, সে হেতু আজ কালো টাকা এক পাশে সরানোই থাক। ডিজিটাল প্রসঙ্গেই আসা যাক বরং। ডিজিটাল অর্থনীতি বা ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত যদি হয়ে উঠতে পারে দেশ, তাতে আপত্তির কিছুই থাকতে পারে না। কিন্তু দেশবাসীকে অভ্যস্ত করে তোলার ব্যবস্থাপনা কোথায়? কোন প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল লেনদেন শেখানো হচ্ছে ভারতবাসীকে?
শেখানোর রীতি সভ্য সমাজে এক রকম। আর যে সমাজ সভ্য নয়, সেখানে আর এক রকম। সভ্য রীতি অনুসারে, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী পরস্পরকে বুঝে এগোতে থাকেন, পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদানের প্রশস্ত পরিসর তাঁরা তৈরি করেন। আর শেখানোর যে রীতি সভ্য সমাজোচিত নয়, সেখানে চাবুক মেরে শেখানো হয়। যে ভাবেই হোক শিখতে হবেই, নচেৎ পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে— শিক্ষকের ভঙ্গি সেখানে এমনই থাকে। দেশবাসীকে ডিজিটাল লেনদেন এই দ্বিতীয় পন্থাতেই শিখতে বলা হচ্ছে না কি?
বিস্তীর্ণ গ্রামীণ ভারত নাগালই পায় না ইন্টারনেটের। ই-ওয়ালেট, প্লাস্টিক মানি, নেট ব্যাঙ্কিং কোনও এক ভিনগ্রহের অস্তিত্ব সেখানে। ডিজিটাল লেনদেন শেখানো দূরের কথা, ডিজিটাল সাক্ষরতাটুকু চারিয়ে দেওয়ার দায়ও কখনও নেয়নি সরকার। এ হেন পরিস্থিতিতে বাজার থেকে নগদ অর্থ রাতারাতি সরিয়ে নিয়ে নাগরিককে বলা হচ্ছে, ডিজিটাল হয়ে যান। শিক্ষা দেওয়ার সভ্য রীতির সঙ্গে আদৌ কি মেলে এ আচরণ?
ডিজিটাল লেনদেনে গুচ্ছ সুবিধা এ বার থেকে, ঘোষণা অর্থমন্ত্রীর। অ-ডিজিটালের জন্য সে সব নেই, বরং নগদের আকাল রয়েছে। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার বাসিন্দারা সরকারের দেওয়া সুবিধাগুলোর সুযোগ নিতে পারবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু অ-ডিজিটাল ভারতের সুবিস্তীর্ণ বিস্তার সে সবের নাগালই পাবে না।
সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, দরিদ্র এবং নিরন্নের কল্যাণেই তো কালো টাকার সর্বনাশ চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সমৃদ্ধির সঙ্গে পথ চলতে অভ্যস্ত ইন্ডিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ বঞ্চনার শিকার ভারতের দূরত্ব ঘুচিয়ে দেওয়াই তো লক্ষ্য ছিল। কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মুহূর্তে শুধু নয়, নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানেও তো তেমনই অঙ্গীকার ছিল। সে যুদ্ধে ইন্ডিয়ার চেয়েও অনেক বেশি করে ভারতই তো নরেন্দ্র মোদীর পাশে দাঁড়িয়েছিল। সব ভুলে আজ এমন নীতি কেন ঘোষিত হল, যার সুবিধা শুধু ইন্ডিয়া নিতে পারবে, একই রাষ্ট্রে, একই পরিসরে, একই ব্যবস্থার অধীনে থাকা সত্ত্বেও ভারত নিতে পারবে না?
নরেন্দ্র মোদীর কার্যপ্রণালীর ‘উপযুক্ত’ রূপক হিসাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি অণুগল্প বেশ জনপ্রিয় হয়েছে সম্প্রতি। সে গল্পেই প্রসঙ্গের ইতি হোক: এক ব্যক্তি তাঁর পুকুরে লুকিয়ে থাকা কুমিরকে জব্দ করতে পুকুরের সবটুকু জল শুকিয়ে নিলেন। শুকনো পুকুর ছেড়ে কুমির দ্রুত বেরিয়ে গেল, ধরা পড়ল না, কারণ সে ডাঙাতেও সমান সাবলীল। মারা পড়ল পুকুরের মাছগুলো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy