প্রতিবাদ: অসমে খসড়া জাতীয় নাগরিক পঞ্জি প্রকাশিত হওয়ার পর নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পিটিআই
এফআইআর-এর পাল্টা এফআইআর, হুমকির পাল্টা হুমকি, রাজনীতির পাল্টা রাজনীতি। অসমে নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ ঘিরে উত্তপ্ত বাংলাও। লোকসভা নির্বাচনের হাওয়া ওঠা শুরু হতেই তৃণমূল এবং বিজেপির সম্মুখসমরে বাড়তি ইন্ধন এই নাগরিক প়ঞ্জি। এ লড়াইয়ের চরিত্র শুধুই ‘সাম্প্রদায়িক’, না কি জাতিসত্তার বৃহত্তর প্রশ্ন জড়িত— তা নিয়ে তর্ক আছে অনেক। কিন্তু ভুললে চলবে না, অসমের নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া এখানে, এই বাংলাতেও, যে বিপুল অংশের মানুষের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে, তাঁরা সকলেই কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী নন। তবে তাঁরা বঙ্গভাষী এবং সীমান্তের ও-পার থেকে আসা। আর তাঁদের এই অনিশ্চয়তার উদ্বেগ পুঁজি করেই নাগরিক পঞ্জির রাজনীতি দানা বাঁধছে এখানে।
‘রাজনীতি’ কথাটা এ ক্ষেত্রে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ দেশের শাসক দল বিজেপি যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করেই নাগরিক পঞ্জির বিষয়টিকে সরাসরি হিন্দু-মুসলমান মার্কা দিয়ে সহজ পথে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চায়। এটা ওই দলের চেনা চরিত্র। একাধিক নেতা প্রকাশ্যে বলেছেন, সীমান্তের ও-পার থেকে আসা অ-মুসলিমদের তাঁরা ‘শরণার্থী’ বলে গণ্য করেন। আর মুসলিমরা হলেন ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’। অর্থাৎ, সীমান্ত পেরোনো মুসলিমদের তাড়িয়ে অন্যদের থাকতে দেওয়া হবে।
এই ধরনের ভাবনা কতটা অমানবিক, ‘হিন্দুত্ববাদী’দের কাছে সেই বিবেচনা আশা করা অর্থহীন। বরং নাগরিক পঞ্জির খসড়ায় চোখ রাখলে যে কেউ বুঝবেন, বিজেপি যা বোঝানোর চেষ্টা করছে, সেটাও এক নির্লজ্জ মিথ্যাচার। কারণ খসড়ায় যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে অ-মুসলিম এবং অসমে বংশানুক্রমিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য বঙ্গভাষী আছেন। আছেন অসমে বংশপরম্পরায় বাস করা বহু মুসলিম মানুষ। তা হলে তো এঁরা সবাই এ বার ‘অবৈধ’ নাগরিক!
এই রকম মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে, সেটাও অবশ্যই রাজনীতি। যার পুরোভাগে তৃণমূল। তাদের প্রধান লক্ষ্য, অসমের এই সব উদাহরণ সামনে রেখে ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপিকে একই সঙ্গে ‘বাঙালি-বিদ্বেষী’ হিসাবেও চিহ্নিত করে দেওয়া। বিশেষ করে বাংলার ভোট-বাজারে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই এই রাজ্যের শাসক তৃণমূল বিষয়টি লুফে নিয়েছে। এই সময়ে তাদের কাছে তো এটাই প্রত্যাশিত! অসমের খসড়া নাগরিক পঞ্জিতে ৪০ লক্ষের নাম বাদ যাওয়ার পরে বাঙালি অধ্যুষিত শিলচরে দ্রুত বাংলার তৃণমূল জনপ্রতিনিধিদের অভিযান এবং অসম পুলিশের জবরদস্তি বাধাদান নিয়ে গন্ডগোল পাকানো, সেই কৌশলেরই অন্যতম অঙ্গ।
অসমে ‘বঙ্গাল খেদাও’-এর ইতিহাস রয়েছে। অসমিয়াদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করেন, বাঙালিদের জন্য তাঁরা নিজেদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে নানা ভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছেন এবং এই বঙ্গভাষীরা সবাই দেশভাগ ও যুদ্ধের সময়ে পুরনো পূর্ব পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে ঢুকে পড়েছেন। তাঁরা সবাই ‘অবৈধ’ বসবাসকারী। অসম শুধু অসমিয়াদের জন্য— এমন একটি জিগির তুলে আন্দোলন অগ্নিগর্ভ হয়েছে সেখানে। নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণপত্রই সেই আন্দোলনে ছাড় পায়নি। ‘বাঙালি বিতাড়ন’ হয়ে উঠেছে সেই সব আন্দোলনের মর্মকথা।
প্রফুল্ল মহন্ত, ভৃগু ফুকন অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পতাকায় ১৯৭৯ থেকে কার্যত বাঙালি তাড়ানোর আন্দোলন করেই সেখানে জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়েছেন। ১৯৮৫-তে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার, অসম সরকার, অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ও অসম গণ সংগ্রাম পরিষদ ‘অবৈধ বসবাসকারী’দের রাজ্যছাড়া করার চুক্তি সই করে। এর পরে অসমে ভোট হয়। প্রফুল্ল-ভৃগুরা অসম গণ পরিষদের সরকার তৈরি করেন।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতির গতিপথ বার বার বদলেছে। রাজনীতির পালাবদল ঘটেছে অসমেও। কিন্তু অপ্রিয় সত্যি বললে, বাঙালি বিদ্বেষের বীজ বোধ হয় উৎপাটিত হয়নি। উজানি অসমের সঙ্গে নামনি অসমের মানসিক দূরত্ব আজও দুস্তর। এখন নাগরিক পঞ্জির খসড়া প্রকাশের পরে সে সবই বিতর্কের উপকরণ।
বিজেপি যে ব্যাখ্যাই দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, তাদের জোট শরিক অসম গণ পরিষদের প্রফুল্ল মহন্ত স্পষ্ট হুমকি দিয়েছিলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল তৈরি করে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে শুধু মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের বৈধতা দেওয়া হলে তাঁরা মানবেন না। তাঁদের মতে, ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক সকলের জন্য সমান ‘সাজা’— বিতাড়ন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা ভাল, নাগরিক পঞ্জির বিধি অনুসারে অসমে ‘বৈধ’ বসবাসকারী তাঁরাই, যাঁরা ১৯৫১-র জনগণনায় নথিভুক্ত এবং যাঁরা ১৯৭১-এর ২৪ অগস্টের আগে এই দেশে চলে এসেছেন। তারিখটি বেছে নেওয়ার কারণ, ২৪ অগস্ট মধ্যরাতের পরে ভারত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেনা পাঠিয়েছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের পরে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। এখন তালিকা তৈরির ফলিত স্তরে ব্যাপারটি ‘বিপজ্জনক’ চেহারা নিয়েছে।
অসম থেকে ‘বিতাড়িত’ বা আতঙ্কিত মানুষজন যদি লাগোয়া রাজ্য বাংলায় ঢুকে পড়তে থাকেন, তবে সেটা নিঃসন্দেহে চাপের কারণ হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে বলুন বা না-বলুন, সেই চাপ ঠেকানো খুব সহজ কাজ নয়। বিশেষত ভোটের মুখে তেমন হতে থাকলে এ নিয়ে রাজনীতির ময়দানে জলঘোলা হওয়ার আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি মমতার বিরুদ্ধে বিজেপি তাদের চিরাচরিত সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগকে বেশি করে শানিয়ে নেওয়ার জন্য হাতে গরম একটি মওকা খুঁজে পাবে। সেই খেলা শুরুও হয়ে গিয়েছে।
তবে অসমের পরে এই রাজ্যেও নাগরিক পঞ্জি তৈরির যে হুমকি বিজেপি দিচ্ছে, মমতার পক্ষে সেটা একটি বড় হাতিয়ার। ওই হুমকির মোকাবিলায় তিনি তাই বাঙালি জাতিসত্তার ‘বিপন্নতা’কে বড় করে তুলে ধরতে তৎপর। মমতা বুঝতে পারছেন, অসমের দৃষ্টান্ত দেখে সীমান্তের ও-পার থেকে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে এই রাজ্যে চলে আসা বহু বাঙালি পরিবারও প্রমাদ গনছেন। তাঁরা আতঙ্কিত— কে, কবে তাঁদের পিঠে ‘অবৈধ’ নাগরিকের ছাপ লাগিয়ে ভিটে ছাড়ার নিদান দেবে। এঁদের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
বিজেপি যতই বলুক এই আশঙ্কার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই, মানুষকে তা বিশ্বাস করানো সহজ নয়। আসলে ভয় কোনও যুক্তির ধার ধারে না। আর সেই ‘ভয়’কেই প্রতিবাদের ভাষা দিয়ে মমতা তাঁর বিজেপি-বিরোধিতায় এ বার ‘জাগো বাঙালি’ আবেগ তৈরি করার বাড়তি সুযোগ পেতে চান।
নির্বাচনী রণকৌশল হিসাবে এটা যদি তিনি ‘কাজে’ লাগাতে পারেন, তা হলে অসমের নাগরিক পঞ্জি-সঙ্কট এই রাজ্যে বিজেপিকে বেগ দেবে না, ভাবার কারণ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy