Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বাঁচা-মরার শিক্ষা

এক দিকে হিংসার আস্ফালন, অন্য দিকে শিক্ষার অমর্যাদা

উচ্চ আধিকারিকের আশ্বাসের মূল্য আছে; অচিরেই নিশ্চয় জানা যাবে, আক্রান্ত শিক্ষকের চিকিৎসা ও অন্য সাহায্যের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ’১৮: পঞ্চায়েত নির্বাচনের কাজ করতে গিয়ে শিক্ষকের মৃত্যুর প্রতিবাদ। কলকাতা, ২ জুন। ছবি: পিটিআই

পশ্চিমবঙ্গ’১৮: পঞ্চায়েত নির্বাচনের কাজ করতে গিয়ে শিক্ষকের মৃত্যুর প্রতিবাদ। কলকাতা, ২ জুন। ছবি: পিটিআই

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৮ ০১:১০
Share: Save:

মনিরুল ইসলাম দেগঙ্গার স্কুলে পার্শ্বশিক্ষক। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দায়িত্ব পালনের সময় দুষ্কৃতীর হাতে গুরুতর জখম হন। এখনও তিনি চিকিৎসাধীন, এমনই থাকবেন হয়তো আরও কিছু দিন। ইতিমধ্যে তিনি বিভিন্ন সরকারি দফতরে কড়া নেড়ে সাড়া পাননি; চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৭০,০০০ টাকা। ব্যাপারটা খবর হওয়াতে এখন সরকার থেকে খানিক উদ্যোগ করা হচ্ছে, স্বয়ং জেলাশাসক বলেছেন তিনি বিষয়টি দেখছেন। (তাঁর দফতরে অবশ্য আগেও জানানো হয়েছিল।)

উচ্চ আধিকারিকের আশ্বাসের মূল্য আছে; অচিরেই নিশ্চয় জানা যাবে, আক্রান্ত শিক্ষকের চিকিৎসা ও অন্য সাহায্যের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঝের দু’সপ্তাহের বিলম্ব নিয়ে তবু প্রশ্ন থেকে যায়। অন্য প্রশ্নও ওঠে। যে রাজ্যে সব সরকারি চিকিৎসা বিনামূল্যে, সেখানে ৭০,০০০ টাকা খরচ করতে হল কেন? সর্বোপরি প্রশ্ন, নির্বাচন কমিশন মনিরুল ও অন্য আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর কোনও ভাবনাচিন্তা করছেন কি? রায়গঞ্জে নির্বাচনকালে প্রয়াত শিক্ষক রাজকুমার রায়ের পরিবারের পাশে? আক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তে কিন্তু এঁরা ছিলেন কমিশনের কর্মী। আইনি দায়িত্বের কথা আইনজ্ঞেরা বলবেন, নৈতিক দায়িত্বের কথা তোলা কি নেহাত প্রলাপ? কমিশনের নৈতিক দায়িত্বের বোঝা বিপুল, সব সামলে হয়তো এ দিকে এখনও মন দিতে পারেননি। ছোট্ট খবরে জানা গেল, এ বিষয়ে এখনও তাঁদের কাছে লিখিত রিপোর্ট আসেনি। খবরের হ্রস্বতা বা শব্দচয়নের জন্য তাঁরা অবশ্যই দায়ী নন। কিন্তু আমরা জানি, অস্বস্তিতে পড়লে দোর্দণ্ড শাসকেরাও ভাববাচ্যে কথা বলেন, যেন ব্যাপারটায় তাঁদের কোনও হাত নেই। আশা করা যায় এ বার তাঁরা কর্তৃবাচ্য প্রয়োগ করে রিপোর্টটি তলব করবেন।

শেষ প্রশ্ন: মনিরুলকে যারা আক্রমণ করেছিল তারা ধরা পড়েছে কি? ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত পুলিশি ব্যবস্থা ছিল, কমিশন তথা রাজ্য সরকার উচ্চ আদালতে সেই মর্মে সনির্বন্ধ আশ্বাস দিয়েছেন। প্রশ্নটা আরও ওঠে এ জন্য যে রাজকুমার রায়ের মৃত্যুর পর প্রতিবাদরত কয়েক জন শিক্ষক এক আধিকারিককে হেনস্থা করার দায়ে গ্রেফতার হয়ে হাজতবাস করেছেন। আইনভঙ্গের অভিযোগ উঠলে নিশ্চয় এই শিক্ষকদের (বা যে কোনও নাগরিকের) বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু একই সঙ্গে অপর এক শিক্ষক (বা যে কোনও নাগরিক) আক্রান্ত হলে তাঁর নিরাপত্তার ও অন্যায়ের বিহিতের অধিকার আছে। যত দূর জানি, দেশের আইন ২৪ পরগনা আর দিনাজপুরে সমান ভাবে বলবৎ। সেই আইনের প্রয়োগে গুরুতর তারতম্য ঘটলে শিক্ষক সমাজের (বা সাধারণ নাগরিক সমাজের) ক্ষোভের অবকাশ আছে।

দুটো বিষয় বিবেচ্য। প্রথমটা ন্যায়ের শাসন নিয়ে। (‘আইনশৃঙ্খলা’ বলব না, অপপ্রয়োগের ফলে শব্দটা অর্থহীন হয়ে পড়েছে।) পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ও পরে মাসাধিক কাল রাজ্য জুড়ে হিংসা অনাচার এমনকি হত্যা ঘটেছে মর্মান্তিক মাত্রায়। সংবাদমাধ্যমের ছবিতে তার পর্যাপ্ত প্রমাণ ধরা পড়েছে, লিখিত প্রতিবেদন বা লোকমুখের বিবরণ না-ই গ্রাহ্য করলাম। ছবিগুলি জাল বলে কেউ দাবি করেননি, অতএব সেগুলি অবিশ্বাস করার কারণ নেই। এই সার্বিক অনাচার ও হিংসা রোধ করতে কোনও তরফের কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি, প্রশমিত করতে পারেননি সাধারণ মানুষের উদ্বেগ। অভূতপূর্ব ভাবে, একের পর এক সরকারি দফতরে ও গণনাকেন্দ্রের মধ্যে তাণ্ডব ঘটেছে, ভোটকেন্দ্রের কথা ছেড়েই দিলাম। (পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিয়ে বিচারালয়ে প্রদত্ত আশ্বাস তবু ভুলি কী করে?) ছেড়ে দিলাম মনোনয়নপর্বে, নির্বাচনের দিনে এমনকি গণনার দিনে হানাহানি ও ভোট বানচালের একের পর এক ক্যামেরাবন্দি দৃশ্য। মনে করা যাক শুধু সেই ছবি: পুলিশে মোড়া, জনতাবিহীন ও আপাতশান্ত সরকারি চৌহদ্দিতে নিষেধ উড়িয়ে অনামী বাইক-আরোহীরা কাতার দিয়ে ঢুকছে। বা, অন্য উপলক্ষে এক বিশিষ্ট নেতা পুলিশের পদস্থ কর্তাকে প্রকাশ্যে ধমকাচ্ছেন, অন্যায় কাজ করার হুকুম জারি করছেন, অন্যথায় নিজেই অপরাধ ঘটাবার হুমকি দিচ্ছেন। রায়গঞ্জের শিক্ষকরা যে যে ধারায় গ্রেফতার হয়েছিলেন, তার কতকগুলি বা অনুরূপ ধারা কি এ ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য ছিল? আইনজ্ঞেরা বলবেন।

আইনের প্রয়োগ যদি উৎকট ভাবে অসম ও পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তার খাঁড়া নেমে আসে কেবল দুর্বল ও ধর্মভীরু মানুষের উপর, ক্ষমতাবান বা নিছক উদ্ধত বেপরোয়া যে কেউ প্রকাশ্যে নিরঙ্কুশ ভাবে আইন ভেঙে দাপিয়ে বেড়ায়, তবে সেই বিক্ষিপ্ত প্রয়োগের সময় দণ্ডবিধির যে ধারা-উপধারাই আওড়ানো হোক, বলতেই হয় আইনের শাসন বলবৎ নেই। এই পরিস্থিতির জন্য কে কতটা দায়ী সে প্রশ্ন অবান্তর; অবান্তর অন্যের হাতে কবে আর কী অনাচার ঘটেছে, কোন দলের ক’জন মরেছে বা মেরেছে, নিহতের সংখ্যা লক্ষ্মণরেখা ছাড়ানোয় আমলাদের মাইনে বাজেয়াপ্ত হচ্ছে কি না। নির্বাচনের সময় ক’টা লোক মারা গেল, এই যদি গণতন্ত্র রক্ষার মাপকাঠি হয়, তা হলে— সভ্য বা সুস্থ সমাজ বলছি না— বাসযোগ্য সমাজ অবশিষ্ট থাকে কি?

এ ভাবে প্রশ্ন করলে অধিকাংশ লোকে একটাই জবাব দেবেন। (তা-ও সকলে দেবেন তো?) মূলে যে সমস্যা, তার সমাধান কিন্তু অধরা থেকে যায়। দ্বিতীয় একটা সমস্যা এই সঙ্গে যোগ করতে চাই।

মনিরুল ইসলাম শিক্ষক, রাজকুমার রায় শিক্ষক, তাঁর মৃত্যুর পর যে প্রতিবাদীরা গ্রেফতার হলেন তাঁরাও শিক্ষক। শিক্ষকরা সমাজের ভাঙা কুলো, ছাই ফেলতে বরাবর তাঁদেরই ডাক পড়ে। পাঁচ বছরে অন্তত তিন বার তাঁরা ভোট সামলান, সেই সঙ্গে ভোটার তালিকা, জনগণনা, আধার কার্ড ইত্যাদি যখন যেটার মরসুম। রেহাই পান না এমনকি মনিরুলের মতো পার্শ্বশিক্ষকরা, যাঁরা তুচ্ছ বেতনে অস্থায়ী ভিত্তিতে, বলতে গেলে খুচরো ভাবে কাজ করেন, প্রকৃত অর্থে যাঁরা সরকারি কর্মীই নন। প্রাথমিক স্কুলে প্রধান (হয়তো এক মাত্র) শিক্ষক হলে মিড-ডে মিল, স্কুলঘর সাফাই ও মেরামত, যত হিসেবনিকেশ চিঠিপত্র রিপোর্ট, নিত্য নতুন উপলক্ষে সরকারি দফতরে হাজিরা— সব সামলাতে হয় একা হাতে। শিক্ষক যদি বা অব্যাহতি পান, স্কুলবাড়ির হরেক ভূমিকা পালন করতে হয়— নির্বাচন কেন্দ্র, ত্রাণশিবির, পুলিশের ছাউনি, নেতাদের সভাস্থল, কী নয়? প্রত্যেক বার ঘটনার আগে-পরেও ভবনটি কিছু কাল বেদখল হয়ে থাকে, ঘর ও আসবাব অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিদ্যুতের বিল মেটাতে প্রধান শিক্ষক আতান্তরে পড়েন।

একটা যুগে এমন ছাড়া উপায় ছিল না, কারণ স্কুলই ছিল গ্রামের একমাত্র বড় পাকা বাড়ি। আজ পঞ্চায়েত অফিস থেকে শুরু করে অন্য বহু ভবন হয়েছে, সেখানে আছেন নানা কিসিমের সরকারি কর্মী। নির্বাচনে তাঁদেরও ডাক পড়ে; কিন্তু স্থান বলুন পাত্র বলুন, সব নিরিখে যে জনপরিষেবাটিতে সবার আগে কোপ পড়ে, প্রশাসনের অন্য যে কোনও চাহিদা মেটাতে যেটাকে সবচেয়ে এলেবেলে, সবচেয়ে পরিহার্য মনে করা হয় তা হল শিক্ষা। ‘আমাদের’ ছেলেমেয়েরা তো ওই সব স্কুলে পড়ে না, ‘আমাদের’ ভাইবোন পুত্রকন্যা পড়ায়ও না বড় একটা। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে ঘরগুলো লেখাপড়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, বাজারদরের অর্ধেক বরাদ্দে যেটুকু জোটে একবেলা খেতে দেওয়া হচ্ছে, নির্দিষ্ট বেতনক্রম না হোক কিছু হাতখরচ জোগানো হচ্ছে মনিরুলের মতো খুচরো মাস্টারদের, আর কী চাই? নির্বাচনের সময় কর্তাদের অনেক গুরুতর চিন্তা থাকে, এই ক্ষমাঘেন্নায় আশ্রিতদের মধ্যে দু’একটা খুনজখম নেহাত কোল্যাটারাল ড্যামেজ।

ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে? একটু ভাবুন তো, পূর্ববর্ণিত অরাজকতার সঙ্গে শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রাঙ্গণের উপর এই অভ্যস্ত আক্রমণের কোনও যোগ থাকতে পারে কি না। মনে রাখবেন, এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ গ্রাম্য ঘরের ছেলেমেয়েরা, যাদের অনেকে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। গত ক’বছরে কিছু ভাল কাজ হয়েছে। বহু স্কুলবাড়ির চেহারা ফিরেছে, চালু হয়েছে কন্যাশ্রী শিক্ষাশ্রী প্রভৃতি বিভিন্ন উপকারী প্রকল্প, স্কুলশিক্ষার অন্য উন্নতিও হয়েছে কিছু কিছু।

তার ফলে ব্যবস্থাটার মৌলিক বা কাঠামোগত সংস্কার কতটা ঘটেছে? আর আজকের প্রসঙ্গে জিজ্ঞাস্য: জনশিক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্য যে গণতন্ত্র, তার ভিত শক্ত হয়েছে কি? না কি উন্নয়নের প্রাপ্তি রয়ে গিয়েছে কেবল দয়ার দান, ক্ষমতাবানের দাক্ষিণ্য— হিংসা-অনাচার যেমন ক্ষমতাবানের অধিকারবিলাস?

দুর্বলের বিলাস পোষায় না, কোনও রকমে উন্নয়ন-অনুদানের খুদকুঁড়ো ঘরে তুলতে পারলেই যথেষ্ট। শেষ অবধি কিন্তু সে হিসাবটাও মেলে না। পাইপয়সার ফারাকের কথা বলছি না; হঠাৎ বিপর্যয়ে অথবা তিলে তিলে বেড়ে ওঠা সর্বনাশে সবটুকু খোয়া যায়। কুলোয় ফেলা ছাই থেকে তখন বেরিয়ে আসে ক্ষোভ আর আত্মমর্যাদার আধপোড়া অঙ্গার। তাতে সচরাচর বিপ্লব ঘটে না, ঘটে কাজ নেই। একটা পরিবর্তন কিন্তু ঘটে— এক দিন না এক দিন আমাদের মনের ভিতর, অজান্তে। তার পরও এক দিন ধরা পড়ে— ইতিমধ্যে সমাজের গায়ে যে ক্ষত হয়েছে তা সারার নয়, তার প্রকোপ বাড়ছে বই কমছে না। যে সমাজে এক দিকে হিংসার উল্লম্ফ আস্ফালন, অন্য দিকে শিক্ষার অমর্যাদা, তার সময়টা বড় সুখের নয়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE