Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
‘গণতন্ত্রের উৎসব’ আদালত পর্যন্ত গড়াবে কেন?

বিরোধীরাও কলঙ্কমুক্ত নয়

ঠিক যেমন পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে আদালতের নির্দেশ। তা যদি কারও পছন্দ না-ও হয়, তাতে কিছু আসে যায় না। রায় মানতেই হবে।

ধুন্ধুমার: রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে বামফ্রন্টের বিক্ষোভ। ১১ এপ্রিল। ছবি: রণজিৎ নন্দী

ধুন্ধুমার: রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে বামফ্রন্টের বিক্ষোভ। ১১ এপ্রিল। ছবি: রণজিৎ নন্দী

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৫১
Share: Save:

সরকার, আদালত, নির্বাচন কমিশন প্রভৃতি সংবিধানসম্মত প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ মর্যাদা এবং মহত্ত্বে গরীয়ান। কার অধিকারের ক্ষেত্র কতটা, কেউ সেই সীমা লঙ্ঘন করলেন কি না, করলে কতটা, সে সব কূট তর্কের ধৃষ্টতা আমার নেই। তার জন্য বিশেষজ্ঞরা আছেন। কিন্তু সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ হিসাবে বিচারব্যবস্থার প্রতি আমরা সবাই শ্রদ্ধাশীল। এটাই রীতি। এক আদালতের কোনও রায় কারও মনোমতো না হলে উচ্চতর আদালতের কাছে যাওয়ার আইনি অধিকার তাঁর আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত রায় যা-ই হোক, সেটা মেনে নিতে আমরা বাধ্য। সেখানে কোনও ট্যাঁ-ফোঁ করার জায়গা নেই।

ঠিক যেমন পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে আদালতের নির্দেশ। তা যদি কারও পছন্দ না-ও হয়, তাতে কিছু আসে যায় না। রায় মানতেই হবে।

তবে এক জন সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে একটি পরিস্থিতি দেখার সুবাদে কিছু প্রশ্ন এবং সংশয় মনে জাগে। সমাজপতিদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, নির্বাচনের মতো একটি ‘গণতন্ত্রের উৎসব’-এ বার বার আদালতকে ঢুকতে হয় কেন?

সবাই জানেন, পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে মামলা এ বারেই প্রথম নয়। গত বারেও মামলা হয়েছিল। পাঁচ বছর আগে তৃণমূলের আমলেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডে কমিশনের ‘ক্ষমতার’ সীমা নির্ধারণ নিয়ে সরকারের এক্তিয়ার চ্যালেঞ্জ করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সেই মামলা হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যায়। মূল মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। তবে সে বার কার্যত নির্বাচন কমিশনের পক্ষেই গিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ। কমিশনের চাহিদা মতো ভোট হয়েছিল পাঁচ দফায়। কেন্দ্রীয় বাহিনীও এসেছিল।

আরও এক বার নির্বাচন কমিশন আদালতে উপস্থিত। তবে এ বার মামলা করেছে বিরোধী দলগুলি। শাসক দল এবং কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের। যার মূল কথা হল, শাসক দলের ‘সন্ত্রাস’-এ বিরোধীরা ঠিকমতো মনোনয়ন জমা দিতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনও তাদের ‘উপযুক্ত’ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ।

বিষয়বস্তু পৃথক। কিন্তু পর পর দু’বার দু’টি মামলার দিকে তাকালে একটি জিনিস নজর এড়ায় না। তা হল, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপর রাজ্য সরকারের ‘প্রভাব’ খাটানোর প্রবণতা নিয়ে মূলত অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এটা ঠিক বা বেঠিক, উচিত বা অনুচিত— সেটা আদালত এবং আইনের পণ্ডিতেরা বলবেন। তবে এ কথা ঠিক যে, নির্বাচনের মতো একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বার বার আদালতের দরজায় নিয়ে যাওয়া হলে সেটা কোনও শাসকের পক্ষেই ভাল দৃষ্টান্ত তৈরি করে না।

যদিও সন্ত্রাস নিয়ে বিরোধী দলগুলি যে সব অভিযোগ তুলছে, নির্দিষ্ট ভাবে সেগুলি নিয়ে আলোচনার পরিসর এটা নয়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে কিছু কথা বলা যেতে পারে।

ভোটে সন্ত্রাস পশ্চিমবঙ্গের পরিচিত ছবি। যদি কেউ ইতিহাস-বিস্মৃত না হন, তবে দীর্ঘ বাম শাসনে এই রাজ্যে সন্ত্রাসের ভয়াল চেহারা তাঁর মনে থাকার কথা। পঞ্চায়েত-পুরসভা-লোকসভা-বিধানসভা সব নির্বাচনেই সন্ত্রাসের বিবিধ প্রকরণ মানুষ দেখেছেন। আজ যাঁরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে মারধর, হুমকি-শাসানির অভিযোগে সরব, তাঁদের নিজেদের হাতেমুখেও সেই কলঙ্কের কালি প্রভূত পরিমাণে লেগে রয়েছে।

প্রত্যন্ত গ্রামের কথা তো দূরস্থান। শহরের দু’একটি ঘটনা বলি। মনে আছে, আজকের মুখ্যমন্ত্রী যখন বিরোধী নেত্রী, তখন লোকসভা ভোটের সময় খাস কলকাতার কসবা অঞ্চলে একটি স্কুলের মাঠে খোলা পিস্তল এবং লাঠি নিয়ে এক দল ছেলে তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। পুলিশ অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল দর্শকের ভূমিকায়। সে দিন কী করে নিজের জোরে তিনি ‘বেরিয়ে’ আসতে পেরেছিলেন, সেই দৃশ্যের সাক্ষী ছিলাম। আসনটিতে যথারীতি সিপিএম জিতেছিল।

এক বার কলকাতা পুরসভার নির্বাচনের দিন বৌবাজার অঞ্চলে প্রবল গোলমাল। এখনকার এক তৃণমূল নেতা তখন সেখানে কংগ্রেস প্রার্থী। দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, মুড়িমুড়কির মতো বোমা পড়ছে। পিস্তলধারী এক দল ছেলের তাড়া খেয়ে ওই ভোটপ্রার্থী প্রাণভয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকে দরজায় খিল দিলেন। সশস্ত্র ভিড় তাঁর বাড়ির গেটে আছড়ে পড়ল। তিনি ঠকঠক করে কাঁপছেন। বড় রাস্তায় কর্তব্যরত এক পুলিশ অফিসারকে রিপোর্টারেরা এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই ঝটিতি জবাব, ‘‘বোমা পড়ছে? কোথায়? শুনতে পাচ্ছি না তো!’’

আরামবাগ, খানাকুল, গোঘাট, গড়বেতা, কেশপুর, হলদিয়া, বর্ধমান, বীরভূম ইত্যাদি অনেক জায়গা সন্ত্রাসের পীঠস্থান বলে নাম কিনেছিল। এলাকায় ঘুরতে গেলে শোনা যেত বিরোধী প্রার্থীদের বাড়ি সাদা থান পাঠিয়ে দেওয়ার কাহিনি। বহু বাড়িতে প্রার্থীকে ভয় দেখানোর জন্য তাঁর স্ত্রীর কাছে থান পাঠিয়ে বলে দেওয়া হত, স্বামী ভোটে দাঁড়ালে বিধবা হতে হবে। স্বামীহারা হওয়ার আতঙ্কে অনেক স্ত্রী তাঁদের স্বামীদের নিরস্ত করতেন। ছেলেমেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি, ধোপানাপিত বন্ধ করা, পুকুর ব্যবহার করতে না দেওয়া, এ সবও ছিল।

আশির দশকে এক বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় খানাকুলে চোখে পড়েছিল রাস্তার মাঝখানে বড় বড় হরফে লাল রঙের লিখন: ‘ভোটে লড়তে সাবধান!’ কে লিখেছে, কোনও উল্লেখ ছিল না। তবে বিরোধীরা প্রার্থী খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে গিয়েছিল। এ সব প্রকরণকে তখন বলা হত ‘নীরব সন্ত্রাস’।

দিন বদলেছে। সন্ত্রাসের চেহারা আরও বেপরোয়া। ইদানীং তো স্কুল কমিটি বা আবাসনের পরিচালন সমিতির ভোটেও বাহুবলীদের দাপাদাপি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আসলে যেখানে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ন্যূনতম পরিস্থিতি তৈরি হবে, সেখানেই প্রতিরোধের চেষ্টা আগ্রাসী ভূমিকা নেবে। এটাই চিরকালের অলিখিত নিয়ম। আর কে না জানে— জোর যার, মুলুক তার।

একই সঙ্গে লক্ষ করার হল পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা। সর্বকালেই শাসক দলকে পুলিশ, প্রশাসন বিশেষ সমীহ করতে অভ্যস্ত। মেরুদণ্ড বন্ধক রাখার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। ফলে ঝান্ডার রং বদলে গেলেও ক্ষমতাসীনরা সর্বকালেই বেপরোয়া হতে অভ্যস্ত। এ বারেও তার অন্যথা হয়নি। তৃণমূল এখন সেই দায় বইছে।

তা বলে বিরোধীদের দিক থেকে কোনও প্ররোচনা নেই, সবই শাসকের দোষ এটা বললেও অতিসরলীকরণ হবে। কারণ এখনকার ‘প্রধান বিরোধী দল’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ রোজ বুক ফুলিয়ে যে ভাষায় হুমকি এবং হিংসাত্মক প্ররোচনা দিচ্ছেন, তা তৃণমূলের অনুব্রত মণ্ডলের মতো ব্যক্তিদের চেয়ে খুব আলাদা কিছু নয়। যাঁরা কাগজে-কলমে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠতে চাইছেন, তাঁদের চেহারা দেখেও তাই আতঙ্ক বাড়ে।

তবু বলতে হবে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আদি পর্ব থেকেই এ বার হামলার ঘটনা যে ভাবে সামনে এসে গেল, সেটা অভূতপূর্ব এবং কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষের সহনক্ষমতা রীতিমতো চাপে। ‘শো’ এখনও শেষ হয়নি। আরও কী কী দেখতে হবে, কে জানে!

রাজ্য প্রশাসন অবশ্য বলেছে, অশান্তির ঘটনা ছ’সাতটির বেশি নয়। কিন্তু, এক হাঁড়ি দুধে এক ফোঁটা চোনা়ই যথেষ্ট। তাই ঘটনার সংখ্যা দিয়ে এ সব ক্ষেত্রে গুরুত্ব বিচার চলে না। এটা বুঝতে হবে।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে এ হেন ‘গণতন্ত্রের’ প্রতি সাধারণ মানুষের আর কত দিন শ্রদ্ধাভক্তি, আস্থা থাকবে, বলা শক্ত। শাসক, বিরোধী সকলের কাছে বিনীত জিজ্ঞাসা, এমন একটি ভোটে যাঁরা জিতে আসবেন, তাঁরা এর পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মুখ দেখে দাড়ি কাটতে বা বিনুনি বাঁধতে পারবেন তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE