বিরোধীদের একত্রিত করার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। —ফাইল চিত্র।
মঞ্চ বাঁধার কাজটা সফল ভাবেই সম্পন্ন হল। আলোচ্য ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সর্বসম্মত প্রার্থী বাছাই। আলোচ্য ছিল জাতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতিও। ১৭টি বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দেশের রাজধানীতে সমবেত হলেন, আলোচনায় অংশ নিলেন। সর্বসম্মত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী খুঁজে বার করা সম্ভব হবে কি না, বৈঠকে তা নিশ্চিত করা গেল না ঠিকই। কিন্তু বিরোধী দলগুলির মধ্যে এক মঞ্চে হাজির হওয়ার যে তাগিদ তৈরি হয়েছে, তা স্পষ্ট একটা অবয়ব পেল।
মূল লক্ষ্যটা কিন্তু এই রকমই ছিল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরেই উদ্যোগটা গড়ে উঠেছে, সে কথা ঠিক। কিন্তু আবার বলি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন উপলক্ষ মাত্র। মূল লক্ষ্য দেশ জুড়ে দ্রুত সঞ্চারিত হতে থাকা গৈরিক তরঙ্গের সামনে প্রতিরোধটা দৃঢ় করে তোলা।
শাসকের পালে তীব্র হাওয়া দেশের সিংহভাগে। সে ঝড়ের সামনে পিছু হঠতে হচ্ছে, ধরাশায়ী হতে হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতির একের পর এক মহারথীকে। একজোট না হলে অস্তিত্বই টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে উঠবে কারও কারও পক্ষে। বিরোধী দলগুলির সামনে এই মুহূর্তে শাসকের মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় যে বৃহত্তর জোট গড়ে তোলা, তা নিয়ে কারও সংশয় নেই। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো একটি আধা-অরাজনৈতিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সেই আদ্যন্ত রাজনৈতিক সমীকরণটাকে রূপ দেওয়া সম্ভব, নয়াদিল্লিতে ১৭টি বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বৈঠকে বসার আগে তা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। ঐক্যের প্রয়াস যে শেষ পর্যন্ত একটা অবয়ব পেল, বিরোধী দলগুলি নিঃসন্দেহে তার জন্য সনিয়া গাঁধীকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। একই ভাবে সাধুবাদ পাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কারণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সর্বসম্মত প্রার্থী বাছাইয়ের প্রস্তাব রেখে বিরোধীদের একত্রিত করার বিষয়ে সর্বাগ্রে উদ্যোগ নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।
অসামান্য পরিমিতি বোধের পরিচয় দিল বিরোধী দলগুলো। সনিয়া গাঁধীর আহ্বানে যে নেতারা বৈঠকে তথা মধ্যাহ্নভোজে হাজির হয়েছিলেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজের নিজের দলের শীর্ষনেতা বা প্রথম সারির নীতি নির্ধারক। তাই এই বৈঠকে বিরোধীদের তরফ থেকে কোনও একটি নামকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে ফেলা একেবারেই অসম্ভব কাজ ছিল না। কিন্তু সে পথে বিরোধী দলগুলি হাঁটল না। ঐক্যের মঞ্চটা গড়ে নিয়েই বলটা তারা ঠেলে দিল শাসকের কোর্টে। ধর্মনিরপেক্ষ, সংবিধান সম্পর্কে অভিজ্ঞ, সর্বজনগ্রাহ্য কারওকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে বেছে নিক সরকার পক্ষ— বার্তা দিলেন বিরোধীরা। তেমন কোনও প্রার্থীর নাম ঘোষিত হলে সমর্থন জানাতে আপত্তি নেই বিরোধী শিবিরের। কিন্তু সরকারের প্রস্তাবিত নাম অপছন্দ হলে, পাল্টা প্রার্থী দেবে সম্মিলিত বিরোধী পক্ষ। দেওয়া হল এমন বার্তাও।
একটি মাত্র বাণ, দু’টি লক্ষ্যভেদের চেষ্টা। ১৭টি দল নেহাৎ রাজনৈতিক স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়নি, জাতীয় স্বার্থে গঠনমূলক বিরোধিতার মঞ্চ গড়ে তুলেছে— গোটা দেশে এই বার্তা চারিয়ে দেওয়াই হল প্রথম লক্ষ্য। আর দ্বিতীয় লক্ষ্য হল, সদ্য গড়ে ওঠা ঐক্যের মঞ্চকে আরও জমাট হওয়ার সুযোগ দেওয়া। প্রথমেই অতিসক্রিয় হয়ে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর নাম ঘোষণা করার পথ নেওয়া হল না। শাসকের কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে আরও একটু সময় নেওয়া হল, বিরোধী শিবিরের অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়াটা আরও একটু বাড়িয়ে নেওয়ার অবকাশ তৈরি করা হল।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতির ভিত্তিতে হবে কি না, না হলে ক’জন প্রার্থী থাকবেন, কোন পক্ষের প্রার্থী শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেন— সে সব প্রশ্নের মীমাংসা হতে এখনও কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার যে প্রয়াস শুরু হয়েছে, সে প্রয়াস যে এখনও পর্যন্ত সফল এবং সঠিক দিশায়, তা বেশ স্পষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy