Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

পিছুটান নিয়ে থাকলে হবে?

আমার কৈশোরের আবাসিক বিদ্যালয়ে শুধু নয়, বাঙালি মননে অনেকটাই জায়গা জুড়ে আছেন নরেন্দ্রনাথ। যেমন আছেন রবীন্দ্রনাথ, সর্বঘটে, আবাসিক জীবনের বাইরের সমাজে যাঁর উপস্থিতি স্বামীজির চেয়ে হয়তো ঢের বেশি।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০৮
Share: Save:

ছোটবেলার স্কুলের সহপাঠী এখন রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী; মাঝেমধ্যেই স্বামী বিবেকানন্দের নানাবিধ বাণীর সংকলন করে ই-মেল মারফত তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের পাঠান। স্বামীজি যুবসমাজের কাছে কী চেয়েছিলেন, যুবসম্প্রদায়কে কী কী করতে বলেছিলেন, জেনে মনে বেশ বল পাই; সারা দিনের পাথেয় হিসেবে ই-মেলটা নিয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে পড়ি।

আমার কৈশোরের আবাসিক বিদ্যালয়ে শুধু নয়, বাঙালি মননে অনেকটাই জায়গা জুড়ে আছেন নরেন্দ্রনাথ। যেমন আছেন রবীন্দ্রনাথ, সর্বঘটে, আবাসিক জীবনের বাইরের সমাজে যাঁর উপস্থিতি স্বামীজির চেয়ে হয়তো ঢের বেশি। কৃষি থেকে শিক্ষা যে কোনও নীতি স্থির করতে আজও আমরা কবিগুরুর শরণ নিই, যেন আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর, সব সমস্যার সমাধান তিনিই দিতে পারেন।

আরও আছেন রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, অরবিন্দ, সুভাষচন্দ্রাদি মহাজ্ঞানী, আমরা নিজেদের জীবনের দিশা স্থির করতে যাঁদের পথ ধরে চলাটাই শ্রেয় মনে করি। কারণ হয়তো মহামানবদের প্রতি (অন্ধ) বিশ্বাস, অথবা নিছক গড্ডলিকা প্রবাহ। আমরা হয়তো ভাবি, এক বার এঁদের যখন মনীষী স্টেটাস দিয়েছিই, তা হলে দায়িত্বটাও তাঁদের ঘাড়েই চাপাই। সমস্যা আমাদের, এখনকার, তাতে কী, নিশ্চয়ই এঁরা আগেই সমাধান তৈরি করে রেখে গিয়েছেন, নোটবুক খুলে দেখে নিলেই হল! সারা জীবন ধরে এত এত যখন লিখেছেন, তার মধ্যে আমাদের এখনকার কথা ভেবেও কিছু তো বলেছেন; ঊনত্রিশ খণ্ড তন্নতন্ন করে খোঁজাই এখন একমাত্র কাজ।

আমরা শুধু মনীষীমুখাপেক্ষী নই, অতীতচারী। কথায় কথায় অতীত-পাড়া আমাদের অভ্যাস; যে কোনও তর্ক আলোচনাতেই আমাদের মূল প্রতিপাদ্য হল আগেকার যুগে আমরা কত উন্নত ছিলাম, অতীতে আমরা কী ভাবে কী কী সাফল্য পেয়েছি। যুক্তিটা পরিষ্কার— আগে যে ভাবে চলেছি, এখনও সেই ভাবে পা ফেললেই ভবিষ্যতের পথ সুগম হবে।

যুক্তিটা হাস্যকর। দেড়শো-দুশো বছর তো দূর, গত চল্লিশ বছরেই আমাদের দুনিয়া আমূল বদলে গেছে। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি অঙ্গ এখন অন্য ধরনের, অতএব, তজ্জনিত সমস্যাগুলোও ভিন্ন মাত্রার। বর্তমান প্রজন্ম আজ কল্পনাও করতে পারবে না, আমাদের ছোটবেলায় টিভিই ছিল না, ইন্টারনেট তো বাদই দিলাম। আমাদের যে মা সত্তরের দশকে সকালে ঘুঁটে ভেঙে ভেঙে গুল-কয়লা দিয়ে উনুন ধরাতেন, সেই মায়ের হাতেই আজ স্মার্টফোন, আমেরিকা-প্রবাসী ছেলে-মেয়েকে সাত-সকালে হোয়্যাটসঅ্যাপে ভিডিয়ো কল করেন!

ঘরের কথা শুধু নয়, বাইরের বিশ্বকেও তো আজ সম্পূর্ণ অচেনা ঠেকে। বিশ্বায়ন শব্দটাই দু’তিন দশক আগে খায়-না-মাথায়-দেয় দশায় ছিল; চিনের উন্নয়নের মডেল বা ব্রেক্সিট তো তখন স্বপ্নেও আসেনি। নব্বইয়ের গোড়াতেও আমাদের দেশের বাজার মুক্ত ছিল না। বিদেশে পড়তে যাবার আগে কয়ে-ককিয়ে কয়েকশো ডলার কিনে পাসপোর্টে সে কথা লিখিয়ে তবে প্লেনে উঠতে হত; আজকের মোবাইল ফোন দিয়ে ঘরে বসে মানি-ট্রান্সফারের কথা সে যুগে সায়েন্স-ফিকশনেও লেখা হয়নি।

অতএব, বৈদিক যুগে ভারতে প্লাস্টিক-সার্জারি হত এটা ভাবা যেমন মূর্খামি, তেমনই রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে দেশ বা সমাজ গড়তে বলেছেন সে ভাবে আজকের দিনে কাজ করাটাও মোটেই কাণ্ডজ্ঞানের লক্ষণ নয়। রবীন্দ্র-রচনাবলি পড়ে শিখতে হবে বইকি, কিন্তু সেই শিক্ষাটা হল কী ভাবে, নতুন ভাবনাচিন্তা করতে হয়, সমস্যার সমাধান বার করতে হয়। তাঁরা অবশ্যই জ্ঞানী ও দূরদর্শী ছিলেন। তবে, দূরদর্শিতা কথাটার মানে সময়ভেদ-বিস্মৃতি নয়, কালজয়ী অর্থ কালকে উপেক্ষা করা নয়; তা হলে তো তাঁদের যুগান্তকারী চিন্তাধারাই আজ অচলায়তনে পরিণত হবে। একশো বছর পরে জন্মালে নরেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় সমাজ গড়ার কথা বলতেন, তবে অন্য ভাবে।

রাজনীতিবিদদের নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজও পুরনোতেই বেশি মজে আছেন। আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অনেকাংশই আজ অতীতের চর্বিতচর্বণ। বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে ফিল্ম-স্টাডিজ, অর্থনীতি থেকে ভূতত্ত্ব সবেতেই নতুন চিন্তা, নতুন তত্ত্ব আবিষ্কারের চেয়ে এখন যেন বেশি জোর দেওয়া হয় পুরনো তত্ত্ব জানার উপরই। দেখে উদ্বেগ হয় বইকি!

আজ নরেন আমাদের কলেজে থাকলে তাই নিশ্চিত বলতেন, খালি পিছন দিকে চেয়ে থাকলে হবে? সামনে চল!

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

habits past Swami Vivekananda Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE