Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

গ্যাস চেম্বারের পথে পৃথিবী?

ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, বিজ্ঞানীদের ভাষায় এটাই ‘নিউ নরমাল’। অর্থাৎ এমনটাই এখন ঘটছে, আগামী দিনেও ঘটবে। প্রসঙ্গত, গত এক দশকে প্রায় প্রতি বছর বিশ্বের গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আগের রেকর্ড অবহেলায় ভেঙে ফেলেছে; সম্প্রতি ‘ল্যানসেট’-এর মতো বিজ্ঞান পত্রিকা জানিয়েছে, শুধুমাত্র ভারতে হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে গত কয়েক দশকে।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

জার্মান সরকারের আমন্ত্রণে জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতি নিয়ে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক দলের ভারতীয় সদস্য হিসাবে সবে বার্লিন থেকে বন শহরে পৌঁছেছি। অক্টোবর মাস। বহু ক্ষণের সফরের পর হোটেলের ঘরে ঢুকে দেখি বেশ গরম, এয়ারকন্ডিশনারটি সম্ভবত কাজ করছে না। অভিযোগ জানাতে রিসেপশনের কর্মী বিব্রত স্বরে জানালেন, ‘‘আসলে এই সময়ে তো এমন গরম পড়ার কথা নয়, বরং ঠান্ডা পড়ার কারণে প্রতি বছর এই সময় এয়ারকন্ডিশনার বন্ধ করে ঘরগুলিতে গরম হাওয়া দেওয়া হয়, এ বারেই এখনও এমন অদ্ভুত গরম, তাই এই সমস্যা।’’ মনে পড়ল, ২০১০ সালে প্রায় একই সময়ে বন-এ এসেছিলাম, তখন ঠান্ডায় প্রায় জমে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল! মনে পড়ে গেল সদ্য শোনা জার্মান পরিবেশ আধিকারিকের খেদ: জার্মানিতে এ বছর তো প্রায় বৃষ্টিই নেই!

ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, বিজ্ঞানীদের ভাষায় এটাই ‘নিউ নরমাল’। অর্থাৎ এমনটাই এখন ঘটছে, আগামী দিনেও ঘটবে। প্রসঙ্গত, গত এক দশকে প্রায় প্রতি বছর বিশ্বের গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আগের রেকর্ড অবহেলায় ভেঙে ফেলেছে; সম্প্রতি ‘ল্যানসেট’-এর মতো বিজ্ঞান পত্রিকা জানিয়েছে, শুধুমাত্র ভারতে হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি বাড়লে কী হবে, সারা পৃথিবীর প্রায় একশো বিজ্ঞানী তা নিয়ে তিন বছর গবেষণা করে জানিয়েছেন, এমন পরিস্থিতিতে পৃথিবী জুড়ে সমুদ্রের কাছাকাছি থাকা মানুষের একটা বড় অংশ সাংঘাতিক বিপদগ্রস্ত হবে, পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ মানুষ বছরে এক বার সাংঘাতিক গরমে পুড়বেন, প্রাণী ও গাছপালার চার থেকে আট ভাগ চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন না হলে তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি বা আরও বেশি তাপ বাড়ার সম্ভাবনা, এবং সে ক্ষেত্রে এই সব বিপদ দ্বিগুণ থেকে দশগুণ বাড়তে পারে। রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক পরিবেশ প্রকল্প দাবি করেছে, ‘প্যারিস এগ্রিমেন্ট’-এ কার্বন নিঃসরণ কমাবার যে অঙ্গীকার ছিল, তা অন্তত তিনগুণ বাড়াতে না পারলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি দূরস্থান, ২ ডিগ্রিতেও আটকে রাখা যাবে না। আর যত তাপমাত্রা বাড়বে, সমুদ্রের জল যত উঁচু হবে, অত্যন্ত বেশি গতিসম্পন্ন ঝড়ের সংখ্যা যত বাড়বে— তত বিপন্ন হবে উত্তরাখণ্ড থেকে কেরল, মুম্বই থেকে চেন্নাই, এবং অবশ্যই আমাদের সুন্দরবন ও কলকাতা। একের পর এক রিপোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তনকে আর আগামী দিনের সমস্যা বলে পার পাওয়া যাবে না, তা প্রবল ভাবে বর্তমান সময়ের সমস্যা!

পোল্যান্ডের কাটোভিসা শহরে সম্প্রতি শেষ হওয়া আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে আরও বেশ কয়েকটি গবেষণার ফল প্রকাশ হয়েছে। তার থেকে স্পষ্ট, কত বড় বিপদের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি আর তা সামলাতে বিশ্ব জুড়ে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা কতখানি উদাসীন! জার্মানির এক পরিবেশ সংস্থার একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী জুড়ে গত কুড়ি বছরে প্রায় পাঁচ লক্ষ পঁচিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দুই দশকের হিসাবে ভারতে মৃত্যুসংখ্যা প্রায় ৭৩০০০। পাশপাশি, ২০১৭ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, যে দেশে ওই বছরই রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেছেন যিনি, তিনি মনে করেন আসলে জলবায়ু পরিবর্তন বলে কিছু হচ্ছেই না! উক্ত পরিবেশ সংস্থার আর একটি রিপোর্ট দেখাচ্ছে, এমন চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে অধিকাংশ দেশ এখনও নিঃসরণ বাড়িয়ে চলেছে। মনে রাখতে হবে, আমেরিকা এক দিকে প্যারিস চুক্তি থেকে বেরোনোর জন্য চিঠি পাঠিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জকে, অন্য দিকে সম্মেলনের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে উপস্থিত থেকে সার্বিক মতামতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। এবং মূলত আমেরিকা ও তার সহমর্মী দেশগুলির কারণেই প্যারিস চুক্তি সত্ত্বেও আর্থিক সাহায্য-সহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়েছে, এক পা এগিয়ে দু’পা পিছোতে হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনাকে। শেষ পর্যন্ত একটি ‘কাটোভিসা প্যাকেজ’ হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে উন্নত দেশগুলির কার্বন নিঃসরণ কমানোর স্পষ্ট সময়সীমা নেই, নেই আর্থিক সাহায্যের রূপরেখা বা প্রযুক্তি আদানপ্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্পষ্ট কর্মসূচি বা জলবায়ু পরিবর্তনে ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলিকে সাহায্যের বন্দোবস্ত।

সৌরশক্তির মতো বিষয়ে ভারত গত কয়েক বছরে অনেক উন্নতি করেছে। প্রধানত তার জোরেই, ভারত ২০৩০ সালে গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্‌গিরণের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছবে বলেই মনে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র সৌরশক্তিতে শান দেওয়াই কি যথেষ্ট? উন্নয়নের নামে একের পর এক বনাঞ্চল শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, দেশের পরিবেশ আইনকে নিয়ম করে দুর্বল করা হচ্ছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক আলোচনায় ভারতের একমাত্র রণকৌশল নিজের ঢাক পেটানো আর অন্য অপরাধী দেশগুলিকে (বিশেষত আমেরিকা বা সৌদি আরব) বিব্রত না করা। ফলে জয়রাম রমেশের সময়ে যথেষ্ট গুরুত্ব পাওয়া ভারত জলবায়ু পরিবর্তন সামলাতে পদক্ষেপ সত্ত্বেও আজ মাঝবেঞ্চের ছাত্র!

কাটোভিসা থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে আউশউইট্স ও বার্কেনু, যেখানে নাৎসিরা লক্ষ লক্ষ মানুষকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরেছিল। গাইডের মুখে সেই ভয়াল ইতিহাস শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, আমাদের কি পৃথিবী নামক গ্যাস চেম্বারে ঢোকার সময় হয়ে এল? উত্তরটা আমাদের নেতাদের হাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Global Warming Pollution Gas Chamber Earth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE